নদী বিধৌত অপূর্ব সুন্দর এক জেলা চাঁদপুর। পদ্মা-মেঘনা ও ডাকাতিয়া এ জেলার ব্যাবসার-বাণিজ্য তথা ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলার সাথে যোগাযোগ মাধ্যমকে সহজ করে দেয়ার পাশাপাশি চাঁদপুরকে দিয়েছে এক নৈসর্গিক সুন্দর রুপ।
তবে প্রতিটা সুন্দরের আড়ালে কোনো না কোনো কষ্ট বা ত্যাগ লুকিয়ে থাকার মতোই সুন্দরের নিদর্শন এই ত্রিনদী কারো কারো জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র দাপট কমে গেলেও উত্তাল মেঘনা এখনো শান্ত হয়নি। থেমে থেমে বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়াকে উপলক্ষ করে মেঘনার বুকে আঁছড়ে পড়ছে বিশালাকৃতির একেকটি ঢেউ।
ভয়ংকর এসব ঢেউকে বৃদ্ধঙুলি দেখিয়ে চাঁদপুরের পশ্চিমাঞ্চলের চরবাসীকে সাথে নিয়ে প্রতিদিন-ই মেঘনা পাড়ি দিচ্ছে ইঞ্জিন চালিত শতাধিক ছোট ছোট নৌ-যান।
কারণ এসকল ছোট ছোট নৌ-যানগুলোই চরাঞ্চলের সহ¯্রাধিক পরিবারের পারাপারের একমাত্র সম্বল। নৌ-যানগুলো কোনো প্রকার লাইফ জ্যাকেট কিংবা লাইফ বয়া না থাকলেও ঝুঁকি নিয়েই তারা ঝড়-তুফানকে পাশ কাটিয়ে নদীতে চলাচল করছে।
খোঁজ নিয়ে দেখাযায়, চাঁদপুর সদর উপজেলা, মতলব উত্তর ও হাইমচর উপজেলার পশ্চিমে রয়েছে পদ্মা ও মেঘনা নামক দু’টো নদী। আর এ দু’টো নদীর পশ্চিম পাড়ে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ৪০ টি চরাঞ্চল।
এসব চরাঞ্চলে দেড় থেকে দুই লাখ লোকের বসবাস। প্রায় প্রতিটি চরেই স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন হাটবাজার গড়ে উঠেছে। এসব চরাঞ্চলের ৯০ ভাগ মানুষ নদীতে মাঝ ধরা ও কৃষি কাজের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। জেলার ৩টি উপজেলার নদী সিকিস্তি এসব চর এলাকার মানুষের দৈনন্দিন কাজ বা চিকিৎসার জন্য ছুটতে হয় শহরের উদ্দেশ্যে।
এছাড়াও পশ্চিম অবস্থিত প্রতিবেশী শরিয়ত জেলার বেশকিছু চরাঞ্চল পদ্ম-মেঘনার তীরবর্তী হওয়ায় ওই সকল এলাকা থেকেও বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রতিদিন সহ¯্রাধিক মানুষ চাঁদপুর শহরে আসা-যাওয়া করে। নদী সিকিস্তি এরসকল চরাঞ্চলের মানুষগুলোর জেলা সদরে যোগাযোগের একমাত্র বাহন হচ্ছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা (ট্রলার)।
বহুকাল ধরে ওই এলাকার সাথে জেলা সদরের উন্নত যাতায়েত ব্যাবস্থা না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই অনেকটা নিরুপায় এসকল শিশু ও নারী-পুরুষ সহ সবাই ট্রালারে নিয়মিত আসা যাওয়া করেছে।
গত ২৯ মে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝর ‘মোরা’ প্রভাবে হাঠাৎ করে উত্তাল হয়ে উঠে পদ্মা- মেঘনা। কোনো প্রকার অনাকাঙ্খিত দূর্ঘটনা ছাড়াই ঘূর্ণিঝর ‘মোড়া’ বঙ্গোপসাগর হয়ে বাংলাদেশ পাড়ি দিলেও উত্তাল পদ্মা-মেঘনা এখানো শান্ত হয়নি।
অশান্ত পদ্মা-মেঘনায় এখনো বিশালাকৃতির ঢেউ আর ঢেউয়ের গর্জন শোনা যায়। ভয়ংকর এই ঢেউকে পাশ কাটিয়ে এখনোও নিয়মিতই ছোট নৌ-যানগুলো চলাচল করছে।
চরাচঞ্চলবাসীল সাথে আলাপ করে জানা যায়, চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজার ট্রলার ঘাট, ভূইয়ার ঘাট, মতলব, হরিণা ও হাইমচর থেকে প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত ইঞ্জিনচালিত ছোট-বড় ট্রলার রাজরাজেশ্বর, চরকাশি, চরওমেদ, চরফ্যাশন, বোরচর, ইশানবালা, ৬ষ্ঠখ- বোরচর, আলুর বাজার, আলগী, সুরেশ্বর, চেয়ারম্যানঘাট সহ বিভিন্ন চরাঞ্চলের চলাচল করছে।
এসব ট্রলারে ১০০/ ১৫০ জন পর্যন্ত নারী-পুরুষ ও শিশু যাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়েপদ্মা-মেঘনার ১০/১৫ মাইল পূর্ব-পশ্চিম নদী পাড়ি দিচ্ছে।
এছাড়াও ট্রলারগুলোতে একই সাথে যাত্রীদের ঠাসাঠাসি করে উঠানো পাশাপাশি ওই এলাকার হাটবাজারের ব্যাবসায়ীদের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উঠানো হচ্ছে। যার ফলে সামান্য ঝড়, প্রভল ¯্রােত অথবা উত্তাল ঢেউয়ে প্রয়ই ট্রলারগুলো ভারসাম্যহীন হয়ে নদীতে ডুবে যাচ্ছে। এতে প্রাণহানীর ঘটনাও ঘটছে অহরহো।
চরাঞ্চলের নিত্যদিন পারাপার হওয়া ষাটর্ধ যাত্রী হালিম শেখের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ঝড়ের কারণে নদীতে প্রচন্ড ঢেউ হচ্ছে। তার পরেও জীবনের ঝূঁকি নিয়ে আমরা নদী পাড় হচ্ছি। গত ১০ বছরে পদ্মায়-মেঘনায় ছোট-বড় প্রায় ১৫/২০টি নৌকা ও ট্রলার ডুবে গেছে। এতে ২০/৩০ জনেরমতো প্রাণহানি ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও লক্ষ-লক্ষ টাকার মালামাল নদীর তলদেশে হারিয়ে গেছে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪ নং রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের বাসিন্দা রহমান ছৈয়াল চাঁদপুর টাইমসকে জানান, প্রতিদিন চরাঞ্চল থেকে কাঁচা তরকারি, মাছ ও প্রচুর পরিমাণে দুধ শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই জীবীকার প্রয়োজনে তাদের এই নদীপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।
তিনি জানান, চরাঞ্চলের এসকল মানুষগুলো গর্ভবতী মা’ সহ অসুস্থ্য রুগীদের হাসপাতালে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুক্ষিণ হয়। তাছাড়া বিকেলের পর থেকে যাত্রি পারাপারের কোনো নৌ-যান না থাকায় অনেক সময় তারা অসহায় বনে যান।
তাদের দাবি সরকারি ব্যবস্থায় এই নদী পথে যদি উন্নত নৌ-যানের ব্যবস্থা করা হয় তবে এই মানুষগুলো উপকৃত হতেন।
চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪নং রাজরাজেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হযরত আলী বেপারী চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে নদীতে ঢেউ অনেক বেড়ে গেছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই জীবীকার প্রয়োজনে অসহায় মানুষগুলো নিত্যদিন নদী পাড়ি দিচ্ছে।’
তিনি আরো জানান, ‘বর্ষাকাল ছাড়াও সব মৌসুমেই চরাঞ্চলের মানুষ ট্রলারে যাতায়াত করে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও কিছু করার নেই। কারণ জেলা সদরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রাখতে অন্য কোনো মাধ্যম নেই। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া দেখা দিলেও অনেক সময় যাত্রী ও মলামালসহ ট্রলারগুলো ডুবে যায়। আমরা প্রশাসনের কাছে বারবারই দাবি করেছি চরাঞ্চলের মানুষের নিরাপদ যাতায়েত ব্যবস্থার জন্য উন্নত নৌযানে ব্যবস্থা করার জন্য।’
তিনি জনান, ‘এ ঝড়ের মৌসুমে সরকারিভাবে অন্ততপক্ষে ট্রলারগুলোতে যদি কিছু লাইফ জ্যাকেট ও বয়া দেয়া হয় তবে অনাকাঙ্খিত যে কোনো দুর্ঘটনা যাত্রীরা কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।’
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ‘জেলার মেঘনা নদীর সীমানা ৩৬০ দশমিক ১১ কিলোমিটার। এরমধ্যে পদ্মা-মেঘনা ও ডাকাতিয়া এ তিন নদীর সংযোগস্থল মেঘনা-মোহনা। এই নদীগুলো তিন দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে মিশে যাওয়ায় এখানে সর্বক্ষণ পানির এক বিশাল ঘূর্ণীগর্তের সৃষ্টি হয়। এই ঘূর্ণিগর্ত এলাকাটি জাহাজ চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারিভাবেও চাঁদপুরকে ঝূঁকিপূর্ণ নৌপথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’
প্রতিবেদক- আশিক বিন রহিম
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৭: ২০ পিএম, ১ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ