পুুলিশ হয়েও গত দুই বছরে প্রায় দুই শতাধিক নারী ও শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়েছেন চট্টগ্রামের মেয়ে সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহমুদা বেগম। মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছেন অন্তত অর্ধশত শিশুকে। সহযোগী কয়েকটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুনর্বাসন করেছেন আরো অর্ধশতাধিক শিশুকে।
গত এক বছরে তথা ২০১৫ সালে প্রায় ২০০ জন নির্যাতিত নারীকে আইনি সহযোগিতা ও কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে বিবাদ মিটিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
মাহমুদা বেগম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করা এ নারী ব্যক্তি জীবনে এক সন্তানের মা। কুমিল্লার তিতাসে পৈতৃক বাড়ি হলেও বাবার চাকরি সূত্রে জন্ম চট্টগ্রামে। পরে কর্ণফূূলীর তীর বন্দর নগরী চট্টগ্রামেই বেড়ে ওঠা তাঁর। বাবা এ এফ এম জাহিদুল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা। মা নিলুফা বেগম গৃহিণী। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।
পড়া-লেখা শেষ করে ২০১০ সালের পাঁচ ডিসেম্বর ২৮তম বিসিএস পুলিশে যোগদান করেন তিনি। আলাপাকালে মাহমুদা বলেন, ২৮তম বিসিএস পরীক্ষায় পুলিশ ব্যাচে নির্বাচিত হয়ে সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম যখন তখন প্রকাশিত হয় ২৯তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল।
ওখানেও কাস্টমস ক্যাডারে নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু পড়ে যান দো টানায়। কোনটাকে বেছে নেবেন? পুলিশ ক্যাডার নাকি কাস্টমস ক্যাডার? সমাজ, সংসার ঠিক রেখে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়া নীরবে-নিভৃতে চাকরি করে জীবন ধারনের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে কাস্টমস ক্যাডারে।
আর পুলিশ ক্যাডারের মাধ্যমে সরাসরি সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসা যায়। সিদ্ধান্ত নিলেন পুলিশ ক্যাডারেই থাকবেন। অসহায় মানুষকে সহায্য করতে কাস্টমস্-এর চেয়ে বাংলাদেশ পুলিশই উপযুক্ত জায়গা বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, আজ প্রায় পাঁচ বছর হলো আমি এখন বাংলাদেশ পুলিশের গর্বিত একজন সদস্য। কাস্টমস বিভাগে যোগদান করলে হয়তো মানুষের খুব কাছাকাছি থাকার এ সুবর্ণ সুযোগটি পেতাম না।
মাহমুদা বলেন পুলিশের পোশাক পড়েও বঞ্চিত নারী শিশুদের জন্য কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। তাকে পোশাকে দেখে বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা বেশি অনুপ্রাণিত হয়।
কাজ করতে গিয়ে পুলিশ হিসেবে যতটা সফল ততটা সফল হয়েছেন একজন নারী হিসেবেও। একজন নারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হননি এখনোও পর্যন্ত।
তিনি বলেন, এটি একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। এ পেশায় মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগি হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে। ট্রাফিক পুলিশে দায়িত্ব পালনকালীন যখন পোশাক পড়ে রাস্তায় নামতাম তখন সবাই ইতিবাচক ভাবে আগ্রহ নিয়েই সহযোগিতা করতেন।
তাই পেশাটাকে যথাযথ মর্যাদার সাথে মনে-প্রাণে গ্রহণও করেছেন তিনি। নিজেকে গড়ে তুলেছেন একটু ব্যতিক্রমভাবেই।
তিনি জানান, ২৭ এপ্রিল ২০১৫। সিএমপি’র কোতোয়ালী থানা এলাকায় জুয়েল হোসেন নামে আট বছরের এক শিশুকে খুঁজে পায় পথচারীরা। পরে কোতোয়ালী থানা পুলিশের মাধ্যমে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয় শিশুটিকে।
শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় জুয়েলের চিকিৎসা করানো হয়। জানা যায়, ভারতের আগরতলার সুনামুরা থানার বাসিন্দা জুয়েল। বাংলাদেশে অবস্থানরত কুমিল্লার নানুর বাড়িতে বেড়াতে এসে হারিয়ে যায় সে।
ব্যাস্, এতটুকুই ইনফরমেশন ছিল পুলিশের হাতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর অন্যান্য প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাড় করা হয় সুনামুরা থানার ফোন নম্বর। যোগাযোগ করা হয় ভারতীয় পুলিশের সাথে। তাদের সহযোগিতায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সুনামুরার অজ পাড়াগাঁ থেকে জুয়েলের মা-বাবাকে খুঁজে বের করা হয়।
এরপর কিছু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রায় আটদিন পর বিজিবি ও বিএসএফ এর সহায়তায় সুনামুরা থানা পুলিশের মাধ্যমে জুয়েলকে বাবা-মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি পড়ার সময় সহজ মনে হলেও কাজটি করা ছিল বেশ কঠিন। কিন্তু সেটি সেদিন সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র মানবিক দায়বদ্ধতার কারণে।’
শুধু জুয়েল নয়, হারিয়ে যাওয়া এমন অর্ধশতাধিক শিশুকে মায়ের কোলো ফিরিয়ে দিয়েছেন এ নারী পুলিশ কর্মকর্তা।
২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগে যোগ দেন তিনি। একই সাথে দায়িত্ব নেন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারেরও। গত দুই বছরে প্রায় দুই শতাধিক নারী ও শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়েছেন তিনি।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী পুলিশ সদস্য হিসেবে মাহমুদা বেগম অংশ নিয়েছেন আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় সোয়াত প্রশিক্ষণে।
মাহমুদা বলেন, মাত্র ১৪ জন নারী নিয়ে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশে নারী পুলিশের যাত্রা শুরু হয়। সাতজন মহিলা কনস্টবল এবং সাতজন এস আই নিয়োগ দেয়া হয় তখন।
১৯৮৪ সালে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে পুলিশ বিভাগে যোগদেন বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম বিসিএস পুলিশ ক্যাডার ফাতেমা বেগম (বর্তমানে ডিআইজি)। ২০১৩ সালে এসে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী পুলিশ সদস্য হিসেবে ক্রাইসিস রেসপন্স টিম সংক্রান্ত ‘সোয়াত’-এ অংশগ্রহণ করার সুবর্ণ সুযোগ পান তিনি।
তিনি বলেন, সোয়াতের ট্রেনিং সেন্টারে প্রথম যখন শরীরে ৩০ কেজি ওজনের বুলেটপ্রুফ বডি আরমার (ভোস্ট) জড়িয়ে দেয়া হলো তখন তাঁর মরি-মরি অবস্থা। সে ‘বডি আরমার’ পরে অস্ত্র হাতে যখন ফিল্ডে নামলাম তখন নিজের মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতির জন্ম হলো। আমি নারী থেকে হয়ে উঠলাম মানুষ। একজন যোদ্ধা। বাঙালি যোদ্ধা। বাংলাদেশি যোদ্ধা।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভালোই লাগছে এখন। যদিও ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হয় তবুও আমি বিশ্বাস করি কর্মই ধর্ম। হাসতে হাসতে বলেন, কর্ম ছাড়াতো মানুষের পক্ষে বাঁচা অসম্ভব।
তিনি বলেন, জাতির দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শপথ নিয়েছি। বিপদকে কখনো ভয় করি না। প্রয়োজনে দেশের জন্য হাসতে হাসতে মরতে পারবো।
মাহমুদা বলেন, শুধু পেশায় নয় একজন স্ত্রী বা গৃহিণী হিসেবেও তিনি সফল। সংসার জীবনে সাংবাদিক স্বামী আর একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তিনি খুবই খুশি বলে জানান। সংসার একটি টিম ওয়ার্ক বলে মনে করেন তিনি। তার কর্ম গুরুত্ব এবং ব্যস্ততা দুটোকেই তার স্বামী এবং সন্তান ইতিবাচকভাবে দেখেন। (জাগো নিউজ)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট ০৩:৪৬ এএম, ১০ মার্চ ২০১৬, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ