চাঁদপুর

নামে চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তর হলেও কাজে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’

মিজানুর রহমান রানা :

চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তর। ৭ ডিসেম্বর ২০১০ সালে চাঁদপুরে এই পরিবেশ অধিদপ্তরের সূচনা হলেও মূলত এ পর্যন্ত চাঁদপুরের পরিবেশ রক্ষার্থে বা উন্নয়নে কোনো উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম চাঁদপুরবাসীর চোখে পড়ছে না। লোকবলের অভাব ও প্রয়োজনীয় সদিচ্ছার অভাবে এক প্রকার ‘ঠুঁটো জগন্নাথে’ পরিণত হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলা কার্যালয়টি চাঁদপুর জেলার ২২/১৯ স্টেডিয়াম রোড, মেরিন ভিউ (২য় তলা) অবস্থিত। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে জেলার সকল শ্রেণির নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণ করা এর উদ্দেশ্যে। মূলত এর কার্যক্রম জেলার পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমসহ আরো নানাবিধ কার্যক্রম বিষয়ক হলেও বর্তমানে এটি যেনো স্থবির।

জানা যায়, সরকারি নিয়ম অনুসারে এ অধিদপ্তরের দুটি পার্ট বা অংশ। এর মধ্যে রয়েছে প্রশাসন উইং ও ল্যাব উইং। এ প্রতিষ্ঠানটির সৃষ্ট পদ রয়েছে ১২টি। আরে মধ্যে উপ-পরিচালকের পদ ১টি থাকলেও তা বর্তমানে শূন্য। সহকারী পরিচালকের পদ ১টি। এই পদে বর্তমানে কাজ করছেন আরেফিন বাদল নামের এক কর্মকর্তা। তিনি ২০১২ সালে এ পদে যোগদান করে অদ্যাবধি কাজ করছেন। রয়েছে সিনিয়র ক্যামিস্ট একটি পদ, পরিদর্শকের ২টি পদ। এই পদগুলো বর্তমানে শূন্য। একজন একাউন্টেন্টের (হিসাবরক্ষক) পদ রয়েছে এতে কাজ করছেন একজন। তবে উচ্চমান সহকারীর শূন্য পদ রয়েছে ১টি, স্যাম্পল কালেক্টরের ২টি শূন্য পদ। এতে লোকবল নেই। একজন সহকারীর পদ রয়েছে এবং এতে একজন কাজ করছেন। তবে গাড়িচালকের পদ থাকলেও গাড়িও নেই আর গাড়ির চালক পদেও কেউ কাজ করছে না। এছাড়া জানা গেছে একজন আউটসোর্সিং পিয়নের পদে যোগদান করে তিনি কয়েকদিন কাজ করে ছুটিতে গিয়ে আর কর্মস্থলে ফিরে আসেননি।

মূলত একজন সহকারী পরিচালক, একজন একাউন্টেন্ট, একজন ল্যাব সহকারী নিয়ে এটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনো রকম টিকে আছে মাত্র। স্বাভাবিক কার্যক্রম দূরে থাকুক এই প্রতিষ্ঠান তার অস্তিত্ব প্রকাশেও কোনো প্রকার কার্যক্রম দেখাতে পারছে না।

জানা যায়, এ প্রতিষ্ঠানের ভিশন অ্যান্ড মিশন হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্যে দূষণমুক্ত বাসযোগ্য একটি সুস্থ, সুন্দর, টেকসই ও পরিবেশসম্মত বাংলাদেশ গড়ে তোলা, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা, টেকসই পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করা, পরিবেশ সংক্রান্ত আইন-কানুন ও বিধি-বিধান যথাযথ প্রয়োগ, পরিবেশ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং পরিবেশ সুশাসন নিশ্চিত করা।

এ ব্যাপারে চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আরেফিন বাদল চাঁদপুর টাইমসকে জানান, “আসলে আমাদের করার কী আছে। কারণ আমাদের প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। একজন পিয়ন ছিলো, তিনিও কাজে যোগদান করে ছুটিতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। তাছাড়া একটি পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম চালাতে প্রশাসন এবং ল্যাব উইংয়ের যে সমস্ত জনবল একান্ত প্রয়োজন শুধু এ অফিসে তিনজন ব্যক্তি ছাড়া আর কোনো জনবল না থাকায় আমরা কোনো প্রকার কার্যক্রম চালাতে পারছি না। এছাড়াও ল্যাব টেকনিশিয়ান, ল্যাবের আসবাবপত্র, স্যাম্পল কালেক্টর সহ অন্য জনবল একান্ত প্রয়োজন। তবে আমরা আমাদের চাহিদাপত্র জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। গবেষণাগারের মিনি ল্যাবের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি বিষয়েও মন্ত্রণালয়ে রিকুইজিশন পাঠিয়েছি। তারা আশ্বস্ত করেছেন, সহসাই জনবল নিয়োগে সহযোগিতা করবেন। যদি আমাদের পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে আমরা সঠিকভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারবো।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি চাঁদপুর টাইমসকে আরো জানান, “চাঁদপুর জেলার আটটি উপজেলায় আমরা মাত্র তিনজন জনবল কাজ করে কীভাবে সুষ্ঠুরূপে প্রতিষ্ঠান চালাবো? বার বার জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় আমরা জনবল নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি বা পূরণ হয়নি। এখানকার জনবল বিভিন্ন ক্যাডারে চলে যাওয়ায় জনবল সঙ্কটে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় কাজ সমাধা করতে পারছি না।”

এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, বাংলাদেশে পরিবেশ উন্নয়নে এ পর্যন্ত অনেক আইন হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০০০। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০০২। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০। ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৮৯। ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন, ১৯৯২। ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন, ২০০১। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ )আইন, ২০১৩। পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০। পরিবেশ আদালত (সংশোধন) আইন, ২০০২। পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন, ২০১০। মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ,উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০। The Code of Criminal Procedure, 1898. The Building Construction Acts,1952. মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯। | The Bangladesh Water Pollution Control Ordinance, 1970. The Environment Pollution Control Ordinance, 1977.  The Motor Vehicles Ordinance, 1983 (Extracts)  .

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০০২ ২০০২ সনের ৯ নং আইন-এর (২) ধারা ৪(৩)-এর অধীনে মহা-পরিচালক কোনো শিল্প কারখানা, উদ্যোগ বা প্রক্রিয়া বন্ধ, নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ প্রদান সত্ত্বেও উহার মালিক বা দখলদার উক্ত নির্দেশ পালন না করিলে, মহা-পরিচালক উক্ত শিল্প কারখানা, উদ্যোগ বা প্রক্রিয়ার জন্য সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন বা পানির সংযোগ বা এইরূপ সকল সংযোগ বিচ্ছিন্ন বা অন্য কোনো সেবা বন্ধ করিবার জন্য সংশ্লিষ্ট সংযোগদাতা বা সেবা সরবরাহকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবেন। (৩) উপ-ধারা (২) এর অধীন কোনো নির্দেশ প্রদত্ত হইলে, উক্ত সংযোগ বা সেবা প্রদান সংক্রান্ত চুক্তিতে বা অন্য কোনো দলিলে ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উক্ত নির্দেশ অনুসারে উহাতে উল্লিখিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।” ৫। ১৯৯৫ সনের ১ নং আইনের ধারা ৬ এর প্রতিস্থাপন। উক্ত আইনের ধারা ৬ এর পরিবর্তে নি¤œরূপ নূতন ধারা ৬ ও ৬ক প্রতিস্থাপিত হইবে, যথা- “৬। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া সৃষ্টিকারী যানবাহন সম্পর্কে বাধা-নিষেধ।- (১) স্বাস্থ্য হানিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণকারী যানবাহন চালানো যাইবে না বা উক্তরূপ ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ করার লক্ষ্যে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনোভাবে উক্ত যানবাহন চালু করা যাইবে না। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এই উপ-ধারায় “স্বাস্থ্য হানিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস” অর্থ বিধি দ্বারা নির্ধারিত মান মাত্রা অতিক্রমকারী ধোঁয়া বা যে কোনো গ্যাস। (২) উপ-ধারা (১) এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে মহা-পরিচালক বা তাহার নিকট হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যে কোন যানবাহন যে কোন স্থানে পরীক্ষা করিতে বা চলমান থাকিলে উহাকে থামাইয়া তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা করিতে, এইরূপ পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ব্যাপী আটকাইয়া রাখিতে ((detain) বা উক্ত উপ-ধারা লংঘনকারী যানবাহন ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আটক করিতে (seize) বা উহার পরীক্ষাকরণ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারিবেন। (৩) উপ-ধারা (২) এর অধীনে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো যানবাহন পরীক্ষা করা হইলে উক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট আদালতে সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য হইবে। (৪) উপ-ধারা (১) এর বিধান বা উপ-ধারা (২) এর অধীন প্রদত্ত নির্দেশ লংঘনের জন্য সংশ্লিষ্ট যানবাহনের চালক বা ক্ষেত্রমত মালিক বা উভয় ব্যক্তি দায়ী থাকিবেন। ৬ক। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সামগ্রী উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদির উপর বাধা-নিষেধ।- সরকার, মহা-পরিচালকের পরামর্শ বা অন্য কোনভাবে যদি সন্তুষ্ট হয় যে, সকল বা যে কোন প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরী অন্য কোনো সামগ্রী বা অন্য যে কোনো সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তাহা হইলে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, সমগ্র দেশে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় এইরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করিবার বা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত শর্তাধীনে ওই সকল কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ জারি করিতে পারিবে এবং উক্ত নির্দেশ পালনে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি বাধ্য থাকিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত নির্দেশ নিম্নবর্ণিত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে না, যথাঃ- বাঃ পঃ সঃ সংশোধন আইন, ২০০২ ২৪১ (ক) উক্ত প্রজ্ঞাপনে বর্ণিত সামগ্রী রপ্তানী করা হইলে বা রপ্তানীর কাজে ব্যবহৃত হইলে; (খ) কোনো নির্দিষ্ট পলিথিন শপিং ব্যাগের ক্ষেত্রে উক্ত নির্দেশ প্রযোজ্য হইবে না মর্মে উক্ত প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হইলে। ব্যাখ্যা- এই ধারায় “পলিথিন শপিং ব্যাগ” অর্থ পলিইথাইলিন, পলিপ্রপাইলিন বা উহার কোন যৌগ বা মিশ্রণের তৈরি কোনো ব্যাগ, ঠোঙ্গা বা অন্য কোনো ধারক যাহা কোনো সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় বা কোনো কিছু রাখার কাজে বা বহনের কাজে ব্যবহার করা যায়।”

সরকার পরিবেশ সংরক্ষণের জন্যে জনগণের উপকারে এসব আইন করলেও এর চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না এবং চাঁদপুরবাসীও এর সুফল পাচ্ছে না।

Share