ইসলাম

নবী-রাসূলদের সম্মান রক্ষা করা সবার দায়িত্ব

নবী-রাসুলরা মানবজাতির মহান শিক্ষক। মানবসভ্যতার সূচনা থেকে তার উন্নয়ন ও বিকাশে তাঁদের অবদান অসামান্য। মানবজাতির জন্য নবীদের আত্মত্যাগ, বিসর্জন ও অবদানের জন্য আল্লাহ ইহকাল ও পরকালে তাঁদের মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.) সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আমি আপনার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি।’ (সুরা : ইনশিরাহ, আয়াত : ৪)

তবে মুসলিমরা শুধু মুহাম্মদ (সা.)-কে সম্মানের চোখে দেখে না, বরং সব নবী-রাসুলের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় তারা দৃঢ়প্রত্যয়ী। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের সবাই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবগুলো এবং রাসুলদের ওপর ঈমান এনেছে। তারা বলে আমরা তাঁর রাসুলদের মধ্যে তারতম্য করি না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৫)

নবী-রাসুলের সম্মানহানি নতুন কিছু নয়

সম্প্রতি ফ্রান্সে মহানবী (সা.)-এর সম্মানহানির ঘটনা ঘটেছে। তবে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও সমালোচনা নতুন কিছু নয়। আগেকার নবীরাও স্বজাতির অশোভন আচরণের শিকার হয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনার আগেও বহু রাসুলকে মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল। কিন্তু তাদের মিথ্যাবাদী বলা ও কষ্ট দেওয়া সত্ত্বেও তারা ধৈর্য ধারণ করেছিল—যে পর্যন্ত না আমার সাহায্য তাদের কাছে এসেছে।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৩৪)

নবী-রাসুলরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে

ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি (রহ.) তাঁর ‘ইসমাতুল আম্বিয়া’ গ্রন্থের ভূমিকায় নবী-রাসুল (আ.)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি এবং তাঁদের জীবনের সার্বিক পবিত্রতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি যা বলেছেন তার সারকথা হলো, নবী-রাসুল (আ.) ছিলেন ত্রুটি ও বিচ্যুতি থেকে মুক্ত। তাঁদের চরিত্র ও আল্লাহভীতির ব্যাপারে সন্দেহ করার অবকাশ নেই। কেননা আল্লাহ তাঁর কুদরত ও ফেরেশতার মাধ্যমে তাঁদেরকে সব ধরনের ত্রুটি ও মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে রেখেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মন্দ বৈশিষ্ট্য, পাপ ও অপরাধের অভিযোগ অপবাদ বা মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই না। আল্লাহ যেমনটি বলেছেন, ‘তাদের মুখ থেকে যে বাক্য বের হয় তা কতই না জঘন্য। তারা তো কেবল মিথ্যাই বলে।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৫)

নবী-রাসুলদের সম্মান কেন রক্ষা করতে হবে

শরিয়তের মূলনীতি অনুযায়ী আল্লাহর প্রেরিত সব নবী ও রাসুল (আ.) সব ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত। সুতরাং তাঁরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম গবেষকরা যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেন তা হলো—

এক. আল্লাহকে দোষারোপ করা হয় : নবী-রাসুল (আ.) আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ও প্রেরিত। সুতরাং তাঁদের সমালোচনা ও দোষ-ত্রুটি চর্চা করা এবং তাঁদের অসম্মান করা আল্লাহর নির্বাচন ও মনোনয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং তার দায়ভারও আল্লাহর ওপর আরোপ করা হয়। (নাউজুবিল্লাহ) অথচ আল্লাহ সব ধরনের ভুল-ত্রুটি ও দুর্বলতার ঊর্ধ্বে।

দুই. আল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত : নবী ও রাসুলদের সমগ্র জীবন সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত এবং তাঁর বরকতে ধন্য। ঈসা (আ.) সম্পর্কে বর্ণিত দুটি আয়াতে সে ইঙ্গিত লাভ করা যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ৩১)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উত্থিত হব।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ৩৩)

তিন. নবী-রাসুলরা নিজ থেকে কিছু বলেন না : আল্লাহর প্রেরিত পুরুষরা দ্বিন প্রচারের ব্যাপারে নিজ থেকে কিছুই বলেন না; বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু বলা হয় তাঁরা তা-ই প্রচার করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপদগ্রস্তও নয় এবং সে মনগড়া কথাও বলে না। এটা তো ওহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’ (সুরা : নাজম, আয়াত : ২-৪)

চার. শয়তান ও প্রবৃত্তির প্রভাবমুক্ত : আল্লাহর মনোনীত পুরুষরা শয়তানের ধোঁকা ও কুপ্রবৃত্তির প্রভাবমুক্ত ছিলেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে (ইবলিশ) বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি যেমন আমাকে বিপথগামী করলেন তজ্জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের কাছে পাপ কাজকে শোভন করে তুলব এবং আমি তাদের সবাইকে বিপথগামী করব। তবে আপনার নির্বাচিত বান্দারা ছাড়া।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৩৯-৪০)

হাদিসে এসেছে, জিন তথা শয়তানের ওপর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বিজয়ী করা হয়েছে।

পাঁচ. মানবজাতির জন্য অবদান : পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী প্রথম নবী আদম (আ.)-এর মাধ্যমে মানবসভ্যতার সূচনা হয় এবং যুগে যুগে নবী-রাসুলরা সভ্যতার বিকাশে মানবজাতির নেতৃত্ব দেন। তাঁরা শুধু মানুষকে ধর্মীয় জীবন শেখাননি; বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পার্থিব জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোও শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁদের দায়িত্ব ও অবদান সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই উম্মিদের মধ্যে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে যে তাদের কাছে পাঠ করে তার আয়াতগুলো, তাদের পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাহ (প্রজ্ঞা)। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।’ (সুরা : জুমা, আয়াত : ২)

অসম্মানকারীদের প্রতি হুঁশিয়ারি

পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে নবী ও রাসুলদের সমালোচনা ও বিদ্রুপকারীদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে বিদ্রুপকারীদের হুঁশিয়ার করে আল্লাহ বলেন, ‘বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে আমি আপনার জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৯৫)

অন্যত্র রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীর প্রতি আল্লাহর অভিশাপের কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আপনার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীই নির্বংশ।’

(সুরা : কাউসার, আয়াত : ৩)

অসম্মানকারীদের শাস্তি

শরিয়তে নবী-রাসুলদের সমালোচনা ও সম্মানহানি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো ব্যক্তি নবী-রাসুলদের সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত করলে ইসলামী দণ্ডবিধি মতে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘সর্বসম্মতিক্রমে আম্বিয়া (আ.) আল্লাহর দ্বিন প্রচার ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিষ্পাপ। তাদের আনীত বিধানের ওপর ঈমান আনা ওয়াজিব। … এ জন্য ইসলামী আইনজ্ঞরা একমত যে, কেউ নবীদের গালি দিলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। তবে অন্যদের গালি দিলে তা দেওয়া হবে না।’ (মাসায়েলে মানসুরা, পৃষ্ঠা ২৫৬)

তবে মৃত্যুদণ্ডর রায় দেবে ইসলামী রাষ্ট্রের আদালত এবং তা বাস্তবায়ন করবে রাষ্ট্র বা তার প্রতিনিধি। ব্যক্তি ও সমাজ তা নির্ধারণ বা বাস্তবায়ন করবে না। যেখানে ইসলামী আইন বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত নয়, মুসলিম উম্মাহ নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের মাধ্যমে তাদের ঈমানি দায়িত্ব পালন করবে। মুমিনরা নবী-রাসুল ও দ্বিনের সমালোচনা ও বিদ্রুপকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বর্জন করবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবিশ্বাসী ও কিতাবধারীদের মধ্যে যারা তোমাদের দ্বিনকে ক্রীড়া-কৌতুকের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে তাদের তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ কোরো না। আল্লাহকে ভয় কোরো যদি তোমরা মুমিন হও।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫৭)

অসম্মানকারীদের ঠিকানা জাহান্নাম

যারা পৃথিবীতে নবী-রাসুলদের অসম্মান করবে এবং তাঁদের সমালোচনা ও বিদ্রুপের পাত্র বানাবে পরকালে তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘জাহান্নাম—এটাই তাদের প্রতিফল, যেহেতু তারা কুফরি করেছে এবং আমার নিদর্শনাবলি ও রাসুলদের গ্রহণ করেছে বিদ্রুপের বিষয়স্বরূপ।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ১০৬)

 

বার্তাকক্ষ,২৭ অক্টোবর,২০২০;

Share