এবার নদীভাঙন তীব্র হতে পারে

আসন্ন বর্ষা মৌসুমে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১৩ জেলা ভয়াবহ নদীভাঙনের কবলে পড়তে পারে। পদ্মা, গঙ্গা ও যমুনা নদীর ভাঙনে এসব জেলার প্রায় ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিলীন হতে পারে। এছাড়া নদীতে পৌনে চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ২৪১ মিটার মহাসড়ক, সাড়ে তিন কিলোমিটার জেলা ও দেড় কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক চলে যেতে পারে। ভাঙনে দোকানপাট, বসতবাড়ি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার এমনকি হাসপাতালও বিলীন হতে পারে।

সরকারের ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) পূর্বাভাসে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এটি অনুমোদনের জন্য রোববার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে সংস্থাটি। নদীভাঙন কবলিত মানুষের জানমাল রক্ষার্থে সংস্থাটি প্রতি বছর এ ধরনের পূর্বাভাস দেয়। গত বছরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল- প্রায় ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। তবে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। গত বছর প্রায় ৩৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিলীন হয়েছে। মূলত কয়েক দফা বন্যার কবলে পড়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধান তিনটি নদীকে ঘিরে পূর্বাভাস দেওয়া হলেও বাস্তবে মেঘনা, সুরমা-কুশিয়ারাসহ অন্যসব নদীতেও প্রতি বছর তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। বর্ষা মৌসুম শেষে বা বন্যার পর বঙ্গোপসাগরে হু হু করে পানি নামতে থাকায় মেঘনার নিম্নাংশ বা চাঁদপুর থেকে একদিকে বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর; আরেকদিকে ভোলা, লক্ষ্মীপুরেও প্রতিবছর ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। বিশেষ করে তেঁতুলিয়ার কারণে পটুয়াখালীর বাউফল, ভোলার বিভিন্ন স্থানে, লোহালিয়ার কারণে বাউফলের কালিশুরী, দুমকীর চরগরবদী, বরিশালে সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীর কারণে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক পর্যালোচনা খুব কমই হয়। সিইজিআইএসও এ নিয়ে কাজ না করায় প্রকৃত চিত্র হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

সিইজিআইএসের উপদেষ্টা ড. মমিনুল হক সরকারের নেতৃত্বে এ পূর্বাভাস পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করা হয়। রোববার তিনি যুগান্তরকে বলেন, বড় বন্যা মানেই বড় ভাঙন। গত বছর কয়েক দফায় বন্যার কবলে পড়ে দেশ। এ কারণে নদীভাঙনও বেশি হয়েছে। গঙ্গা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে যমুনার বাম তীরের মানুষ। অনেক স্থানে নতুন চ্যানেল তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিগত পূর্বাভাসের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণত ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা (চিহ্নিত) স্থানে লাল পতাকা লাগিয়ে মানুষকে সতর্ক করা হয়। তাদের সংস্থা কেবল উল্লিখিত নদীগুলোর ভাঙন নিয়ে কাজের ব্যাপারে এখতিয়ারপ্রাপ্ত। তাই ঘোষণা থাকলেও মেঘনাসহ অন্য নদীগুলো নিয়ে তারা কাজ শুরু করতে পারেননি।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে মূলত মে থেকে নদীভাঙন শুরু হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত চলে। সিইজিআইএসের ‘নদীভাঙন পূর্বাভাস-২০২১’ এ বলা হয়, এ বছর কেবল দেশের প্রধান দুই নদী অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মার ২০টি স্থান ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে।

সিইজিআইএস’র পূর্বাভাস মতে, এ বছর ১৩ জেলার ২০ স্থানে ভাঙন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যেতে পারে। জেলাগুলো হলো- কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও মাদারীপুর। সংস্থাটি বলছে, এবারের মৌসুমে ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা-গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীপাড়ে ভাঙন চলতে পারে। এতে ৩৪২টি বসতবাড়ি, ৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ২৬টি মসজিদ-মন্দির, পাঁচটি হাটবাজার, দুটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, সাধারণত এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১ হাজার মানুষের বসবাস আছে। সেই হিসাবে এ বছরে নদীভাঙনের কারণে বাস্তুহারা হতে পারে প্রায় ২৮ হাজার মানুষ।

সিইজিআইএসের সহযোগী বিশেষজ্ঞ সুদীপ্ত কুমার হোড় বলেন, তারা ভাঙনের তীব্রতা ও সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি ঝুঁকির ওপর ভিত্তি করে মানুষকে সতর্ক করার কাজ করেন। ভূ-উপগ্রহের ছবি, ভাঙনপ্রবণ এলাকার মাটির ধরন পরীক্ষা ও মাঠপর্যায়ের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ওপর গবেষণা করে ২০টি স্থানকে নদী ভাঙনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৯ সালে এ সংস্থা ভাঙনের যে পূর্বাভাস দিয়েছিল তার মধ্যে ৮০ শতাংশ এলাকা ভেঙেছে। ২০১৮ সালে পূর্বাভাসের ৮৬ শতাংশই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, সিইজিআইএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। এতে প্রায় ১৭ লাখ ১৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। একই সময়ে পদ্মা, যমুনা ও গঙ্গা নদীর অববাহিকায় ৫৮১ বর্গকিলোমিটার নতুন ভূমি জেগে উঠেছে।

অনলাইন ডেস্ক,৭ জুন ২০২১

Share