অটোপাসের নতুন পদ্ধতিতে এইচএসসির ফল প্রকাশের কাজ শুরু হয়েছে। ফল তৈরিতে দিকনির্দেশনামূলক একটি প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। দ্রুত সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। ওই নির্দেশনার ভিত্তিতে একটি নীতিমালা তৈরি করা হবে। নীতিমালার আলোকে চলতি বছরের এইচএসসি-সমমান পরীক্ষার্থীদের গ্রেড পয়েন্ট নির্ধারণ করা হবে।
তবে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় নানা স্তরের শিক্ষার্থী যুক্ত থাকায় তাদের সঠিক মূল্যায়ন বা গ্রেড পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে নতুন পদ্ধতির আলোকে ফল প্রকাশ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গ্রেড নির্ণয়কারী কারিগরি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেএসসি-এসএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে ২০২০ শিক্ষাবর্ষের এইচএসসি’র ফল তৈরি করা হবে। ওই দুই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের এইচএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ দেয়া হবে।
এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজমুল হককে আহ্বায়ক এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে সদস্য সচিব করে আট সদস্যের একটি টেকনিক্যাল কমিটি কাজ করছে। কমিটির সদস্যরা চারটি সভা করে একটি নীতিমালা তৈরির প্রস্তাব এবং ফল তৈরির কিছু দিকনির্দেশনামূলক প্রস্তাবনা তৈরি করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনিক্যাল কমিটির এক সদস্য বলেন, আমরা চারটি সভা করে ফল তৈরি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। সেটি দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এটির অনুমোদন দেয়া হলে এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন-সাপেক্ষে সেই নীতিমালা চূড়ান্ত হলে সকল শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা ফল তৈরির কাজ শুরু করবেন। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে ফল প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল তৈরি করতে গিয়ে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই আসে যে দুই পরীক্ষার ভিত্তিতে গড় ফল তৈরি হচ্ছে, সেটি। কেননা, জেএসসি পরীক্ষার সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকের বেশিরভাগ বিষয়েরই কোনো মিল নেই। বাংলা, ইংরেজি, আইসিটির মতো তিনটি বিষয়ের সঙ্গে যে মিল আছে, সেটি নিতান্তই প্রাথমিক পর্যায়ের। এটির সঙ্গে এইচএসসির তুলনা ও সম্পর্ক স্থাপন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
অপরদিকে, এসএসসি ও দাখিল পাসের পর শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিভাগ পরিবর্তন করেন। এ ক্ষেত্রে বিজনেস স্টাডিজ ও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মানবিক বিভাগে যান। আবার মাদরাসায় দাখিল ও এসএসসি ভোকেশনাল পাস করা অনেকে কলেজে ভর্তি হন। বিভাগ ও ধারা (মাদরাসা ও কারিগরি থেকে কলেজ) পরিবর্তনকারী শিক্ষার্থীদের ফল তৈরিও আরেক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
নাম প্রকাশ না করে একটি বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ফল তৈরিতে জটিলতা তৈরি করেছে গত বছরে এক বা একাধিক বিষয়ে ফেল করা, মানোন্নয়ন ও প্রাইভেটের পরীক্ষার্থীরা। এছাড়া আছে কারিগরি স্তর, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি, ইংরেজি মাধ্যমের ‘ও’ লেভেল উত্তীর্ণ প্রার্থীরা। এসব শিক্ষার্থীর ফল তৈরির ক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। কেননা শেষের তিন স্তরে জেএসসি পরীক্ষা বলতে কিছু নেই। তাদের মূল্যায়নের জন্য দুটি (জেএসসি ও এসএসসি) ফল পাওয়ার সুযোগ নেই।
এছাড়া গত বছর বিভিন্ন বিষয়ে ফেল করা, মানোন্নয়ন ও প্রাইভেট পরীক্ষার্থীদের গ্রেড দেয়ার নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রেও জটিলতা তৈরি হবে। কেননা, তারা তো একবার এই পরীক্ষা দিয়েছেন। এখন তাদের গত বছরের ফল ফেলে দিয়ে আগের দুই পরীক্ষার ভিত্তিতে গোটা গ্রেড দেয়া হবে না, শুধু ফেল করা বা ফরম পূরণ করা বিষয়গুলোতে অতীতের নম্বর বা গ্রেড পাওয়ার প্রবণতা দেখা হবে— এটি নির্ধারণ করা জরুরি। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। এখন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত দরকার, বলেন ওই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম আমিরুল ইসলাম বলেন, এইচএসসি পরীক্ষায় নানা স্তরের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এ কারণে সাধারণ স্তরের বাইরের পরীক্ষার্থীদের গ্রেড নির্ণয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি রয়েছে। এতে কেউ কেউ হয়তো কিছুটা বঞ্চিত হতে পারেন। তবে কেউ যেন তার প্রাপ গ্রেড ও নম্বর থেকে বঞ্চিত না হন, সে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটি নীতিমালা তৈরি করা হবে। তার ভিত্তিতে শিক্ষা বোর্ডগুলোর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা আলোচনা করে ফল তৈরি করবেন।
এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এক বা একাধিক বিষয়ে কিংবা সব বিষয়ে ফেল করা কারিগরি-মাদরাসা-ইংরেজি মাধ্যম-উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আছেন। এই আট গ্রুপ-কে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি (নিয়মিত) গ্রুপ-কে শুধু তার এসএসসির ফলের ভিত্তিতে নম্বরপ্রাপ্তির প্রবণতা থেকে মূল্যায়নের প্রস্তাব আছে।
এক বা একাধিক বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীদের বিষয়ে দুটি প্রস্তাব আছে। একটি হচ্ছে, গত বছরের আংশিক ফল ফেলে দিয়ে তাদের অতীতের দুই পরীক্ষার ফলের আলোকে নিয়মিতদের মতোই মূল্যায়ন করা। আরেকটি হচ্ছে, শুধু ফেল করা বিষয়গুলো মূল্যায়নের জন্য বিবেচনা করা। আর যারা আদৌ জেএসসি পরীক্ষা দেননি, তাদের শুধু এসএসসিতে নম্বরপ্রাপ্তির প্রবণতা থেকে মূল্যায়ন করা হতে পারে।
উল্লেখ্য, এবার মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে নিয়মিত ১০ লাখ ৭৯ হাজার ১৭১ শিক্ষার্থী। অনিয়মিতদের মধ্যে এক বিষয়ে ফেল করা ১৬ হাজার ৯২ জন, দুই বিষয়ে ফেল করা ৫৪ হাজার ২২৪ জন, সব বিষয়ে ফেল করা ৫১ হাজার ৩৪৮ জন, মানোন্নয়ন ১৬ হাজার ৭২৭ জন এবং প্রাইভেট পরীক্ষার্থী ৩৩৯০ জন রয়েছেন। সাতটি বিষয়ে ১৩টি পত্রে পরীক্ষায় বসতে হয় শিক্ষার্থীদের। এর মধ্যে বাংলা ও ইংরেজির দুটি এবং আইসিটির একটিসহ পাঁচ বিষয়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষাসহ সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হয়। বাকিগুলো বিভাগভেদে পছন্দ মতো ঐচ্ছিক বিষয় থাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এইচএসসি-সমমান পরীক্ষায় অটোপাসের সিদ্ধান্তে এবার প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী ফেল থেকে পাস করবেন। ফেল করে পরীক্ষা না দিয়েও তারা সার্টিফিকেট পাবেন। ফলে ভাগ্য খুলছে এসব পরীক্ষার্থীর।
ঢাকা ব্যুরো চীফ,২০ নভেম্বর ২০২০