বিশেষ সংবাদ

নজরুল-প্রমীলা

১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কবি কুমিল্লায় এসে ৪ মাস কাটান। বিভিন্ন কারণেই কবির আসা। কুমিল্লায় কান্দিরপাড় গ্রামের ইন্দোমহন সেনের স্ত্রী বিরজাসুন্দীরকে কবি মা বলে ডাকতেন। বিরজাও নজরুলকে পুত্রস্নেহশীলা ছিলেন। এ পরিবারের বাড়িতে ইন্দোকুমারের বড় ভাই-প্রয়াত বসন্তকুমারের বিধবা স্ত্রী গিরিবালা দেবী। তার একটি মাত্র মেয়ে ছিল-তার নাম ছিল-আশালতা। ডাক নাম ছিল-দুলী বা দোলন।

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা জমিদার বাড়িতে রয়েছে নজরুল-প্রমীলার অনেক স্মৃতি। জমিদার বাড়ির পাশেই প্রমীলা দেবীর বাড়ি ছিল। তার বাবা বসন্তকুমার মারা গেলে প্রমীলা ও তার মা গিরিবালা কুমিল্লা কান্দির পাড় চলে আসেন জেঠার বাসায়। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের শিবালয়ে এর অবস্থান। প্রমীলা দেবীর বাবা বসন্তকুমার সেনের ভাতিজা বীরেন সেনের সঙ্গেও কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিচয় সূত্রে প্রায়ই তাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। এভাবেই প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের দেখা হয় । আর এ সবের অনেক স্মৃতিচিহ্ন রয়ে গেছে আজও।

প্রমলা রূপসী ছিলেন। তাঁকে নিয়েও তিনি বহু কবিতা ও গান লিখেন। নজরুলের ‘দোলন চাঁপা’ কাব্য গ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতা আশালতাকে নিয়েই লিখা। আশালতাও তরুণ ও সুঠামদেহী নজরুলকে ভালোবেসে ফেলেন। কিন্তু বিরজা সুন্দরী চান নি মুসলমান ছেলের সাথে দুলীর বিয়ে হউক। কিন্তু গিরিবালা হয়তো আশালতা সেনগুপ্তের মনের কথা ভেবে-তিনি বিয়ে সমর্থন করেন। কিন্তু তৎকালীন সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এ রকম বিয়ে সম্পন্ন করার কোনোই উপায় ছিল না।

তাই গিরিবালা নজরুলকে পরামর্শ দিলেন-কলকাতায় গিয়ে বাসা ভাড়া করে তাকে জানাতে। খবর বা চিঠি পেলেই তিনি দুলীকে নিয়ে কলকাতা এসে পৌঁছবেন বলে নজরুলকে বললেন। নজরুল তাঁর কথামই কলকাতার ৬নং হাজী লেনে বাসা ভাড়া করেই গিরিবালাকে কলকাতা চলে আসতে বলেন। যথাসময়েই গিরিবালাÑআশালতা ওরফে প্রমীলাকে নিয়ে চলে আসলেন কলকাতায় ।

এ দিকে বিয়ের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব নিলে হুগলী জেলার সরকারি উকিল মাযহারুল আনোয়ার চৌধুরীর মেয়ে ‘মা ও মেয়ে’ উপন্যাসের লিখিকা মিসেস এম.রহমান। তিনিও নজরুলকে ছেলের মত স্নেহ করতেন। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রির শুক্রবার ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ১২ বৈশাখ নজরল-আশালতায় বিয়ে সম্পন্ন হলো। তখন আশালতা ছিলেন ষোড়শী কন্যা।

নজরুল আশালতা সেন গুপ্ত ওরফে-দুলী বা দোলনের নাম দিলেন প্রিয় কবি‘প্রমীলা’। এ বিয়েতে নজরুলের ক’জন বন্ধু উপস্থিত ছিলেন। বিয়ে পড়ান মুঈনুদ্দিন হুসেন নামে একজন কবি। তিনি প্রিয় কবির একজন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন।

ফলে প্রমীলাকে ছেড়ে গিরিবালা আর কুমিল্লায় আসেন নি। তিনি থেকে গেলেন মেয়ে-জামাইয়ের কাছে। কিছুদিন কংগ্রেসকর্মী খগেন ঘোষের বাড়ি,পরে হামিদুল্লাহ নামে এক ভাড়াটিয়র বাড়ি ভাড়া নেন। বিয়ের পর নজরুল মিসেস এম রহমানের ইচ্ছানুযায়ী স্বপরিবারে হুগলিতেই ২ বছর ছিলেন। এখানে তাঁর প্রথম পুত্র আজাদ কামাল জন্মগ্রহণ করেন। তার অপর নাম ছিল কৃষ্ণ মোহাম্মদ। সম্ভবত :৩-৪ মাসের মধ্যেই আজাদ কামাল মারা যায়। প্রমীলা ও শ্বাশুড়ি গিরিবালাকে নিয়ে নজরুল তখন তীব্র দারিদ্রতার মধ্যে দিনাতিপাত করছিলেন। কেননা তাঁর কোনো নির্দিষ্ট আয় উপার্জনের ব্যবস্থা ছিল না।

পত্র-পত্রিকায় অফিস ও প্রকাশকগণ যা দিতেন-তাহাই তিনি গ্রহণ করতেন এবং তা দিয়েই সংসার চালাতেন। তবে এম.রহমান তাঁকে যথাসাধ্য সহায়তা করেন। ১৯২৬ সালের জানুয়ারি নজরুল প্রমীলাকে নিয়ে কৃষ্ণনগরে চলে আসেন। এ বছরই ৯ সেপ্টেম্বর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র অরিন্দম খালিদ জন্ম নেয়। তার ডাক নাম দিলেন নজরুল বুলবুল। নজরুল বুলবুলকে ভীষণ ভালবাসতেন ও আদর করতেন। ১৯৩০ সালে বুলবুল ৪ বছর বয়সেÑ বসন্ত রোগে মারা যায়। বুলবুলের মৃত্যুতে কবি নজরুল ভীষণ ব্যথিত হন এবং ভেঙ্গে পড়েন।

পরবর্তীতে নজরুলের তৃতীয় ছেলে সব্যসাচী জন্ম নেয়। তার আরেক নাম ছিল সানি। তিনি বড় হয়ে কণ্ঠ সঙ্গীত ও যন্ত্র সঙ্গীত শিল্পী হন। তার ছিল দু’স্ত্রী । প্রথম স্ত্রীর নাম উমা কাজী এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ড.অঞ্জলী মুখার্জী। ৪র্থ ছেলের নাম ছিলÑঅনিরুদ্ধ কাজী। তার ডান নাম ছিল নিনি। তার স্ত্রীর নাম ছিলÑকল্যাণী কাজী। কবির কোনো কন্যা সন্তান ছিল না। তবে একজন পালিতা কন্যা ছিল তার নাম ছিল শান্তি লতা।

কৃষ্ণনগরে কবি অনেকটা চাল-চলনে, স্ত্রী-পুত্র ও শ্বাশুড়িকে তার সংসার ধর্ম চালিয়ে আসছেন। এখানে থাকতেই কবি মা জাহেদা খাতুন ১৯২৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন তার ডাক মা মিসেস এম.রহমানও।

তথ্যসূত্র :মো.হাবিবুর রহমান রচিত‘ছোটদের নজরুল,নবারূণ ও বাংলাদেশ সচিত্র মাসিক প্রত্রিকা,শেখ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম রচিত-‘নজরুল জীবনের ট্য্রাজেডি’,ডা.আনিস আহমেদের সম্পাদনায়‘কাজী নজরুলের জীবনী’এবং ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত ছবি)(৫ম পর্ব শেষ-চলবে আরও ক’টি পর্ব )

সম্পাদনায়: আবদুল গনি,শিক্ষক,সাংবদিক ও সাধারণ সম্পাদক, নজরুল গবেষণা পরিষদ, চাঁদপুর। ১৫ মার্চ ২০২১।

Share