আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির আবিষ্কার কম্পিউটারের ফলে মুদ্রণ শিল্প এখন হারিয়ে গেছে। আগের হ্যান্ড মেটার টাইপ পদ্ধতি সেকেলে হয়ে যাওয়ায় এর শ্রমিক কর্মচারী বা কারিগর বা শিল্পীরা বেকার হয়ে গেছে। কেউ কেউ বয়সের ভারে নুয়্যে পড়েছেন। কেউ বা আবার পেশাও ছেড়ে দিয়েছেন।
মুদ্রণ শিল্পের কারিগর মরহুম সিরাজ পাটওয়ারী ছিলেন তাদেরই মধ্যে একজন। মরহুম সিরাজ পাটওয়ারী দীর্ঘ ৪০ বছর মুদ্রণ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। আমি সফরমালী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকুরি করা সুবাদে দিন দিন খুবই কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। মৃত্যুর ক’মাস আগে একদিন হঠাৎ করে আমাকে তিনি বললেন, আপনি খুব সুন্দর সুন্দর সংবাদ লিখেন। সহাস্য বদনে আমার সম্পর্কে কিছু একটা লিখুন।’
সাথে সাথেই বসে গেলাম মরহুম সিরাজ পাটওয়ারীর দীর্ঘ ৪০ বছর মুদ্রণ শিল্পের সাথে সম্পৃক্তের অভিজ্ঞতার কথা। তাই আমার ধূসর স্মৃতির আয়নায় মুদ্রণ শিল্পের কারিগর সিরাজ পাটওয়ারীর কর্মময় জীবনের সার সংক্ষেপ উল্লেখ করলাম । এ ছাড়াও আমি তার দু ছেলে ও দু’মেয়ের শিক্ষক বিধায় আমাকে খুব সম্মান করতেন।
চাঁদপুর শহরের ৫ কি.মি.উত্তরে সফরমালী এলাকার সিরাজ পাটওয়ারী দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে চাঁদপুরের বেশ ক’টি সংবাদপত্র প্রকাশের কাজে জড়িত ছিলেন। তার পুরো নাম ছিলো সিরাজুল ইসলাম পাটওয়ারী। পিতার নাম মরহুম সায়েদ আলী পাটওয়ারী এবং মাতার নাম আছিয়া খাতুন।
চাঁদপুর সদরের কল্যাণপুর ইউনিয়নের পশ্চিম কল্যান্দি গ্রামে ১৯৩৩ সালের ৬ ফেব্রæয়ারি সিরাজ পাটওয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। ৩ ছেলে ও ২ কন্যা সন্তানের জনক তিনি ছিলেন। মরহুম সিরাজ পাটওয়ারী ৮১ বছর বয়সে ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন।
ছোটবেলায় নিজ গ্রামের পাঠশালায় তৎকালীন সফরমালী হাই মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৭ সালে এসএসসি সমমানের পরীক্ষায় পাশ করেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সুন্দর করে বাংলা, ইংরেজি ও আরবী জানতেন, কথা বলতে ও লিখতে পারতেন।এসএসসি পাশ করার পর পরই চাকুরির খোঁজে তিনি বিভিন্ন স্থানে ও আত্মীয়-স্বজনের নিকট যান। অবশেষে তার খালু কামিজ উদ্দিন পাটওয়ারীর সান্নিধ্যে এসে হাতে মুদ্রণ বা মেটার টাইপ কাজ শিখেন। শেষ পর্যন্ত এক রকম বাধ্য হয়েই তিনি এ কাজটি জীবনের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেঁচে নেন।
তৎকালীন চাঁদপুর শহর ও পুরান বাজারের জিলানী প্রেস,মাস্টার প্রেস, যমুনা প্রেস ইত্যাদি বিভিন্ন প্রেস ‘হ্যান্ড মেটার টাইপ’ কাজ করতেন। কখনো ডেইলি হাজিরায় কখনো বা মাসিক বেতনে চাকুরি হিসেবে কাজ করতেন।
চাঁদপুরের সাবেক প্রেসক্লাব সভাপতি গোলাম কিবরিয়া জীবন এর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক চাঁদপুর বার্তা, জিলানী প্রেসে বর্তমান চাঁদপুর কণ্ঠ ও রূপসী চাঁদপুর, চাঁদপুর সংবাদ প্রভ‚তি সংবাদগুলোতে পর্যায়ক্রমে তিনি হাতে মেটার বসানোর কাজে করতেন। তখন এসব পত্রিকাগুলো নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক াহসেবে বের হতো। সকাল ভোরে পায়ে ঁেহটে কিংবা সফরমালীর খেয়া নৌকায় পরবর্তীতে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় চাঁদপুর আসতেন। আবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। কোনো কোনো প্রেস মালিক মাসিক বেতন আবার কোনো দিন দৈনিক হাজিরা নিয়েই চলে আসতেন।
তখন দৈনিক হাজিরা ছিল ৬০-৭০ টাকা। পরবর্তীতে তা’বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১শ’৭০ টাকা। তবে জাতীয় সংসদ, ইউপি নির্বাচন কিংবা অন্য কোনো নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ওনাদের কদর বাড়ত। চাঁদপুরের প্রেস ব্যতীত সিরাজ পাটওয়ারী ঢাকা,চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন মুদ্রণ প্রেসে যৌবনের প্রথম ভাগে কাজ করেছেন। তিনি আরবী ভাষায় কোরআন বা বিভিন্ন ইসলামী মূদ্রণের কাজ করতেন।
বাংলা ও ইংরেজির চেয়ে আরবী টাইপ করতে তিনি বেশি পছন্দ করতেন। যার ফলে কোরআন শরীফ ও ছাপার দায়িত্ব পালন করেছেন। সহকর্মীদের মধ্যে আবদুল কাদের, মোবারক হোসেন,বাশার খান,নুরু মিয়া, ফজলুল হক, আলমগীর হোসেন,কৃষ্ণ,নাজির, মধু,সুলতান খান, আ. কুদ্দুস, মজিদ,আহমদ মিয়া,খোরশেদ আলম,বাবুল ইত্যাদি ক’জনের নাম মনে করতে পারছেন বলে জানিয়েছেন।
প্রেসে পত্রিকার পারিশ্রমিকভাবে পেতেন ১শ’টাকা করে ৪ পৃষ্ঠায় ৪শ’টাকা। নিখূঁতভাবে ও ধীরস্থীর ভাবে এসব কাজ করতে হতো। প্রতিটি পৃষ্ঠার কাজ হাতে মেটার বসিয়ে করতে হতো। ছাপানো বাবদ পেতেন ৫০ টাকা পৃষ্ঠা।
এক সময় তিনি মুদ্রণ শিল্প কর্মচারী বা কারিগরদের জেলা সমিতির সভাপতিও ছিলেন। পরবর্তীতে আজকের চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তারা সবাই তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করেন এবং যথাযথ সম্মান দিতেন।
তার দু’ছেলেকেও তিনি মুদ্রণ শিল্পের কাজ শিখিয়েছেন। বর্তমানে তার বড় ছেলে মো. রফিকুল ইসলাম ঢাকাস্থ ভ‚মি অফিসের একজন কর্মকর্তা,মেঝো ছেলে মো.সফিকুর প্রবাসী, ছোট ছেলে আমিনুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে কম্পিউটার গ্রাফিক্সে কাজ করছেন। তিনি ডিবি লটারীর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পান।
ছোট মেয়ে মাষ্টার্স পাস করছেন । মরহুম সিরাজ পাটওয়ারী এক পর্যায়ে কাজী শাহাদাত সাহেবের সাথে পত্রিকা বের করার কাজ দীর্ঘদিন জিলানী প্রেসে ও সাপ্তহিক চাঁদপুর প্রেসে কাজ করেন। বেশ ২-৩ বছর যাবৎ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। চোখেও দেখতে পারতেন না ভাল ভাবে। দাঁতের ও সমস্যা ছিলো বলে তিনি জানান।
মুদ্রণ শিল্পের এ কিংবদন্তী কালের আবর্তে,চাহিদা দিন দিন কমে যাওয়ায় এবং কম্পিউটারের হাওয়া চাঁদপুর এসে পৌঁছায় তিনি ৪-৫ বছর আগে পেশা ছেড়ে বাড়িতে চলে এসেছেন।তার ছেলেরাও ঐ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্যে তাকে অনুরোধ করেছেন। কত নৈপূণ্য ও ধৈর্য্যরে সাথে হ্যান্ড মেটার টাইপের কাজ করতে হত তা বলার অপেক্ষা রাখেনা বলে তিনি জানিয়েছেন।
কালের আবর্তে তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এখন এ শিল্পটির অস্তিত্ব নেই চাঁদপুরে। হ্যান্ড মেটারের বর্ণমালার পরিবর্তে এখন কম্পিউটাররের মাধ্যমে ও সম্পূর্ণস্বংস্ক্রিয় মেশিনে এ সব কাজ চলছে। এদের অনেকেই তাদের সেই পুরনো পদ্ধতির পরিবর্তে নতুন পেশাও বেছে নিয়েছেন।
জীবন সায়াহ্নের সেই টগবগে যুবক ৮১ বছরের পলিত কেশ বৃদ্ধ ২০১৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে তার দু’ছেলে ,২ মেয়ে ও স্ত্রী রয়েছেন । তিনি আজ বেঁচে নেই কিন্ত তার কিছু ধূসর স্মৃতি সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হবে বলে আশা করি। আমরা সংবাদকর্মীরা এককালের মুদ্রণ শিল্পের কারিগর মরহুম সিরাজ পাটওয়ারীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
প্রতিবেদক : আবদুল গনি
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৮:১৫ পিএম, ৫ মে ২০১৮, শনিবার
এজি