সারাদেশ

কুমিল্লায় ৮০ ভাগ ধর্ষণ মামলাই প্রেমঘটিত

কুমিল্লায় বাড়ছে যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনা। এর মধ্যে লোমহর্ষক বর্বরোচিত কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে। চৌদ্দগ্রামে কোচিং শিক্ষকের ধর্ষণে মা হয়েছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী, নাঙ্গলকোটে চাচার ধর্ষণে ভাতিজির কোলে সন্তান, নগরীর শাকতলায় মসজিদের মুয়াজ্জিনের লালসার শিকার হয়েছেন তরুণী, শহরতলীর দুর্গাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে মেয়ের সাথে অনৈতিক সম্পর্কের কারণে গ্রেফতার হয়েছে বাবা, চান্দিনায় মুহতামিমের ধর্ষণের শিকার হয়েছে মাদ্রাসার ছাত্রী।

তবে কুমিল্লার আদালত ও বিভিন্ন থানায় গত দু মাসে যেসব মামলা হয়েছে এসব মামলা বিশ্লেষণে দেখা গেছে প্রায় ৮০ ভাগ মামলাই প্রেমঘটিত। এদিকে, নিকটাত্মীয়, শিক্ষক, মুয়াজ্জিন এর মতো বিশ্বাসের জায়গাগুলোতে পচন ধরায় অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।

গত দুই মাসে কুমিল্লা জেলায় ধর্ষণের ঘটনায় ৩৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত আগস্ট মাসে মামলা হয় ১৩টি এবং সেপ্টেম্বর মাসে মামলা হয়েছে ২১টি। এর মধ্যে থানায় মামলা হয়েছে ২৩টি, আদালতে মামলা হয়েছে ১১টি। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার মামলা হয়েছে মোট ৯টি, যার মধ্যে ২টি মামলা আদালতে দায়ের করা হয়েছে। কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, পরিসংখ্যান এবং মামলার ধরন পর্যবেক্ষণ করে জানা গেছে, ২৮টি ধর্ষণ মামলাতেই প্রেমঘটিত কারণ রয়েছে। মামলার পর্যালোচনা বা তদন্তে দেখা গেছে, ছেলে-মেয়ে বোঝাবুঝি বা সমঝোতার মাধ্যমে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং দৈহিক সম্পর্কে জড়িত হচ্ছে। পরে আবার যখন ঘরে ফিরছে, তখন অভিভাবকদের জানাচ্ছে যে তাদেরকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এসব ঘটনায়ই পরে মামলা হচ্ছে। গত দুই মাসে গণধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩টি এবং জোরপূর্বক ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩টি।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত দুমাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ৮৩টি। ৩৪টি ধর্ষণের মামলা ছাড়াও অপহরণের মামলা রয়েছে ১৯টি, যার বেশিরভাগই প্রেমঘটিত বলছে পুলিশ। এছাড়া যৌতুকের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৫টি এবং শ্লীলতাহানিসহ অন্যান্য ঘটনায় মামলা হয়েছে আরো ৬টি।

কেস স্টাডি-১: প্রথম বর্ষের এক কলেজ ছাত্রীকে গত ১১ জুন কুমিল্লা নগরীর ইস্টার্ন ইয়াকুব প্লাজার সামনে থেকে জেলার দেবিদ্বার উপজেলার আলাউদ্দিন সরকার সানমুন ও তার সহযোগীরা অপহরণ করে। এ ঘটনায় সাতজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। ছাত্রীর বাবা সাংবাদিকদের বলেন, আসামিরা তার মেয়েকে বিভিন্ন স্থানে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। পরবর্তীতে কক্সবাজারের কলাতলী এলাকায় একটি হোটেলে আটকে রেখে তাকে ভারতে পাচারের চেষ্টাকালে প্রায় চার মাস পর গত এক অক্টোবর ওই ছাত্রীকে পুলিশ উদ্ধার করে এবং অপহরণকারী চক্রের আলাউদ্দিন সরকার সানমুনসহ তিন জনকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করে। তবে অভিযুক্ত সাইফুলের পরিবারের দাবি, অপহরণ নয় প্রেমের সম্পর্কের জের ধরে ওই কলেজ ছাত্রী বাড়ি ছেড়েছিল।

কেস স্টাডি-২: মাদরাসা ছাত্রীর সঙ্গে মুঠোফোনে পরিচয়। এরপর তাকে কৌশলে উঠিয়ে নিয়ে বিয়ের নাটক। অতঃপর সিলেটের একটি আবাসিক হোটেলে নিয়ে ধর্ষণের পর প্রেমিকাকে বাথরুমে আটকে রেখে পালিয়ে আসে প্রেমিক রবিউল আউয়াল (২৯)। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রেমিকার দায়েরকৃত মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে তাকে। জেলার ব্রাহ্মণপাড়ায় উপজেলায় ঘটেছে এ ঘটনা। বুধবার আটকের পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল প্রেমিকাকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। গ্রেফতারকৃত রবিউল আউয়াল মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা থানার হায়দারাবাদ গ্রামের খলিলুর রহমানের ছেলে। রবিউলের পরিবারের দাবি, প্রেমের বিরোধ থেকে এ ঘটনার সৃষ্টি। জোর করে তাকে সিলেট নেয়া হয়নি।

এ বিষয়ে কুমিল্লা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাবার প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায় কমবয়সীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব এবং অন্যান্য ইন্টারনেট কনটেন্টের সহজলভ্যতা ও প্রভাব। এছাড়া ইদানীং দেখা গেছে, সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারী কমে গেছে। যার কারণে কমবয়সী ছেলে-মেয়েরা সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে বা ঘর ছেড়ে যাচ্ছে সহজে। তারপর যখন আবার কোন কারণে তারা ঘরে ফিরছে তখন অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে হয় ধর্ষণ মামলা বা অপহরণ মামলা হচ্ছে।

পুলিশ ধর্ষণের সব ক’টি মামলা গুরুত্বের সাথে এবং দ্রুত তদন্ত করে আসামিকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করে। তবে সবক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ করে এই ধর্ষণের ঘটনায় কমিয়ে আনা যাবে না, তার জন্য সামাজিক সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। এই সচেতনতায় সবার আগেই এগিয়ে আসতে হবে পরিবারকে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ধর্ষণ প্রতিরোধে সচেতনতা কার্যক্রম নিয়েও কাজ করতে পারে বলে জানান পুলিশ সুপার।

বার্তা কক্ষ,১৮ অক্টোবর ২০২০

Share