ধর্ষণ একটি পুরুষালী রোগ : এর চিকিৎসা দরকার

প্রভাষ আমিন : 

বিবিসির একটি তথ্যচিত্র নিয়ে এখন তুলকালাম ভারতজুড়ে। বিশ্ব নারী দিবসকে সামনে রেখে বিবিসি ‘ইন্ডিয়াস ডটার’ নামে এই তথ্যচিত্র নির্মাণ করে। তথ্যচিত্রটি ৮ মার্চ নারী দিবসে বিবিসি ও এনডিটিভিতে প্রচারের কথা ছিল। কিন্তু এর কনটেন্ট নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় ৪ দিন আগেই বিবিসি এটি প্রচার করে দেয়। এতেই হইচই পড়ে গেছে। ভারত সরকার হুমকি দিয়েছে বিবিসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। বিবিসিতে নোটিস গেছে তিহার জেল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেও।

কী আছে এই তথ্যচিত্রে? কেন এত বিতর্ক? আসলে ‘ইন্ডিয়াস ডটার’ নানাবিধ প্রশ্ন তুলেছে। সাংবাদিকতার এথিক্স, নীতি নৈতিকতা, নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাব ইত্যাদি নানা প্রশ্নে বিতর্ক চলছে।

২০১২ সালে ৬ ডিসেম্বর রাতে দিল্লির রাজপথে চলন্ত বাসে চার পাষণ্ড নির্ভয়াকে ধর্ষণ এবং নির্মম নির্যাতনের পর বাস থেকে ফেলে দেয়। নির্ভয়া এতটাই আহত হয়েছিল যে সিঙ্গাপুরে নিয়ে চিকিৎসার পরও তাকে বাঁচানো যায়নি। সে ঘটনায় ভারতজুড়ে তুলকালাম হয়ে যায়। ধরা পড়ে ধর্ষকরা। সেই বাসের চালক মুকেশ সিং ফাঁসির দন্ড নিয়ে তিহার জেলে আছে। বিবিসির আলোচিত তথ্যচিত্রটির পরিচালক ব্রিটিশ লেসলি উডউইন ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লির তিহার জেলে গিয়ে মুকেশ সিংয়ের সাক্ষাৎকার নেন। যত বিতর্ক এই সাক্ষাৎকারকে ঘিরেই। মুকেশ সিং কী বলেছে, তাতে যাওয়ার আগে কয়েকটা ব্যাপার দেখে নেওয়া যেতে পারে। তিহার জেল কর্তৃপক্ষ লেসলি উডউইনকে অনুমতি দেওয়ার আগে কয়েকটি শর্ত দিয়েছিল। তার মধ্যে ছিল, এই সাক্ষাৎকার বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না। আর যাই বানানো হোক প্রচারের আগে, তিহার কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। কিন্তু বিবিসি কর্তৃপক্ষ কোনও শর্ত না মেনেই নির্ধারিত সময়ের চারদিন আগেই তথ্যচিত্রটি প্রচার করে ফেলে। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার মানদন্ড বিবেচনা করা হয় বিবিসিকে। তাই বিষয়গুলো নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। আর এই নির্ভয়ার ঘটনায় ভারতে সাংবাকিতার একটি চমৎকার মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। কারণ ধর্ষিতা মেয়েটিকে মিডিয়া চিনলেও তার নাম বা ছবি প্রকাশ করা হয়নি। তার ছদ্মনাম রাখা হয় নির্ভয়া। এই নামটিই প্রচারিত হয়েছে সারাবিশ্বে। এত বড় ভারতের এত মিডিয়া, এই একটা ব্যাপার সবাই মেনে চলেছে, এটা অসাধারণ।

এবার দেখা যাক মুকেশ সিং কী বলেছে। সাক্ষাৎকারে মুকেশ সিংকে মোটেই অনুতপ্ত মনে হয়নি। বরং উল্টো সে এই ঘটনার জন্য নির্ভয়াকেই দায়ী করেছে। মুকেশ বলেছে ‘রাত ৯টার পর যে মেয়েরা বাড়ির বাইরে বেরোয় তাদের উদ্দেশ্যই থাকে পুরুষদের আকৃষ্ট করা।’ মুকেশ সিং আরও বলেছে ‘ধর্ষিত হওয়ার সময় প্রতিবাদ করাই উচিত হয়নি মেয়েটির। চুপ করে থেকে ধর্ষণ হতে দিলে আমরা ওকে মারতাম না। ধর্ষণের পর আমরা মেয়েটিকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিলাম। ওর সঙ্গী ছেলেটিকে খানিক মারধর করি আমরা।’ মুকেশ আরও বলেছে ‘কোনও ভদ্র মেয়ে রাত ৯টার পর রাস্তায় বেরোয় না। ধর্ষণের জন্য ছেলেদের থেকে মেয়েরা অনেক বেশি দায়ী। ছেলে আর মেয়েরা কখনোই সমান হতে পারে না। বাড়িতে থেকে গৃহস্থালীর কাজকর্ম করাটাই মেয়েদের সাজে। রাত ৯টার পর ‘অশালীন’ পোশাক পরে রাস্তায় বেরোনো মেয়েদের কাজ নয়। মাত্র ২০% মেয়েরাই ভাল হয়।’ মুকেশের দাবি তাদের ফাঁসি হলে আখেরে ক্ষতিটা মেয়েদেরই হবে। তার মতে এরপর ধর্ষণ করে কেউ আর ধর্ষিতাকে তাদের মত বাঁচিয়ে রাখবে না। মুকেশ জানিয়েছে, তারা আসলে মেয়েটি ও তার বন্ধুকে ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিল, বোঝাতে চেয়েছিল রাতের বেলা তাদের মোটেও বাড়ির বাইরে বেরনো ঠিক হয়নি।

মুকেশ সিংয়ের এই সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত পত্রিকায় প্রকাশের পরই তুলকালাম। এই তথ্যচিত্র বানানো এবং সম্ভাব্য প্রচার নিয়েই শুরু হইচই। তাই নির্ধারিত সময়ের চারদিন আগেই তা প্রচার করে ফেলে বিবিসি। এখন প্রশ্ন হলো মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একজন ধর্ষকের আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেওয়া এমন সাক্ষাৎকার প্রচার করা উচিত কি উচিত নয়? এই তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করায় ভারত সরকারের সমালোচনা করেছে বিবিসি। তারা একে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছে। সাধারণভাবে মানুষ এই তথ্যচিত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও ভারতেরই কেউ কেউ বলছেন, এই সত্য নিষ্ঠুর, এই সত্য তিক্ত, কিন্তু সত্য সত্যই। তাই সত্য প্রকাশে বাধা দেওয়া উচিত নয়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ধর্ষকের আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেওয়া বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারের বিপক্ষে। আমি বিশ্বাস করি, সব সত্য সংবাদ নয়, সব সংবাদ প্রকাশযোগ্য নয়। গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতার একটি সম্পর্ক আছে। বলা হচ্ছে, এই তথ্যচিত্রে মুকেশ সিংয়ের সাক্ষাৎকারে পুরুষদের মানসিকতা ফুটে উঠেছে। আর এই সাক্ষাৎকার দেখলে ভারতের মেয়েরা বুঝতে পারবে আসল পরিস্থিতি এবং সাবধান হতে পারবে। কিন্তু মুকেশ সিংয়ের মত একজন ধর্ষক তার আত্মপক্ষ সমর্থন করে যে বক্তব্য দিয়েছে, তা যদি একজন পুরুষকেও অনুপ্রাণিত করে, তার দায় কে নেবে? শুধু নিরেট সত্য প্রকাশ করাই তো গণমাধ্যমের দায়িত্ব নয়। গণমাধ্যমের দায়িত্ব গণমানস গঠন। যারা বলছেন, এই তথ্যচিত্র দেখে ভারতের মেয়েরা সাবধান হতে পারবে, তারা কি চাইছেন, মেয়েরা রাত ৯টার পর ঘর থেকে বেরুবে না। তারা কি চাইছেন, মেয়েরা ঘর থেকে বেরুবে নিজেদের আবৃত করে? তারা কি চাইছেন, মেয়েরা ধর্ষকদের কবলে পড়লে চুপচাপ ধর্ষিত হবে, বাধা দেবে না। তারা কি বিশ্বাস করেন, ভারতের পুরুষরা সবাই মেয়েদের সম্পর্কে এমন ধারণাই পোষণ করে? তারা কি বিশ্বাস করেন, ধর্ষনের জন্য মেয়েরাই দায়ী? ভারতের সমাজ সম্পর্কে আমার খুব ভালো ধারণা নেই। কিন্তু তবুও আমি বলতে পারি, ভারতের পুরুষরা মুকেশ সিংয়ের মত নয়। যদি তাই হতো, ভারতের সমাজ-সভ্যতা এতদূর আসতে পারতো না। মুকেশ সিংরা অসুস্থ, অপরাধী। তাদের বক্তব্য ফলাও করে প্রচার করার কোনও প্রয়োজন নেই। এই সাক্ষাৎকারের বহুল প্রচার ভারতের নারীদের আরও বেশি নিরাপত্তাহীন করবে।

মুকেশ সিংয়ের সাক্ষাৎকার পড়ে আমার মনে পড়ে গেল বাংলাদেশে ভিকারুন্নিসা নুন স্কুলের শিক্ষক পরিমলের কথা। পরিমল তার ছাত্রীকে ধর্ষণের পর বলেছিল, ছাত্রী জিন্স-টি শার্ট পড়ার কারণেই সে ধর্ষিত হয়েছে। আসলে ধর্ষকদের কোনও দেশ নেই, সমাজ নেই। এরা অসুস্থ, এরা অপরাধী। এদের কঠোর শাস্তি দরকার। ধর্ষণের দায় মেয়েদের ঘাড়ে চাপিয়ে এই অপরাধীদের আড়াল করার কোনও সুযোগ নেই। মুকেশ সিং বলেছে, তাদের শাস্তি হলো, এরপর আর কোনও ধর্ষক ধর্ষিতাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। কী অদ্ভুত যুক্তি! তাহলে তো সব ধর্ষককে ছেড়ে দিতে হবে। বাংলাদেশে ধর্ষণের আরেকটা অদ্ভুত বিচার চালু আছে। আদালতের বাইরে ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ের মাধ্যমে আপোষ করা হয়। কী আশ্চর্য! যার প্রাপ্য শাস্তি। সে কিনা বিয়ের আসরে মধ্যমনি হয়ে বসার সুযোগ পায়। আপোষের এই ফর্মুলা আমার খুবই অপছন্দ, এটা ধর্ষিতাকে আজীবন একজন ধর্ষকের সাথে জীবন-যাপন করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু আমি দেখেছি, এটাকেই সবাই গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেন। এটা যদি প্রচলিত হয়েই যায়, তাহলে তো ধর্ষকামীরা কোনও সুন্দরী মেয়েকে টার্গেট করে বসে থাকবে। বিয়ে করতে রাজি না হলে সুযোগ বুঝে ধর্ষণ করবে এবং পরে বিয়ে করবে।

শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, সংখ্যায় অল্প হলেও বিশ্বের সব দেশেই ধর্ষক আছে। প্রয়োজন এদের খুঁজে বের করে তাদের মানসিকতা বদলানো, প্রয়োজনে শাস্তি দেওয়া। ধর্ষকের ভয়ে যদি মেয়েরা রাত ৯টার পর ঘর থেকে না বেরোয়, যদি তারা নিজেদের জন্য অস্তস্তিকর পোষাক পড়ে থাকে, যদি তারা পুরুষের পাশে থেকে উন্নয়নে অংশ নিতে না পারে; তাহলে সভ্যতা এগুবে কিভাবে?

ইন্ডিয়ান ডটারদের সম্ভব বাঁচাতেই ‘ইন্ডিয়াস ডটার’ প্রচার বন্ধ রাখতে হবে, শুধু ভারতে নয়, সব জায়গায়। গণমাধ্যম কখনোই একজন ধর্ষকের আক্মপক্ষ সমর্থনের প্লাটফরম হতে পারে না।

লেখক: সাংবাদিক ও অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

Share