ধর্ষণ একটি সামাজিক অপরাধ। প্রতিটি দেশেই এ অপরাধের কঠোর শাস্তির বিধান আছে। এরপরও এ অপরাধ পৃথিবীর অনেক দেশেই মহামারী আকার ধারণ করছে।
আমাদের দেশে ধর্ষণজনিত হত্যায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও শুধু ধর্ষণের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আর এ শাস্তিকে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এ সংক্রান্ত আইন সংশোধনের প্রস্তাব আজ মন্ত্রিসভায় উঠছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃত্যুদণ্ড কোনো সমস্যার সমাধান নয়। শুধু সাজা বাড়ালেই ধর্ষণের এ মহামারী বন্ধ করা যাবে না। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির মাধ্যমে শাস্তিগুলোকে দৃশ্যমান করতে হবে।
একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে ধর্মীয়, মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি অর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনতে হবে। কঠোর আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই অপরাধীদের নিরুৎসাহিত করতে হবে।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হল- মানুষকে সংশোধন করা। অপরাধী না হয়ে উঠার জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
সম্প্রতি নোয়াখালীতে এক নারীকে নির্যাতনের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর থেকে রাজধানীসহ দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ঝড় উঠে। মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চলছে গত ৭ দিন ধরে।
এসব কর্মসূচি থেকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ডের’ দাবি উঠে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার এ আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এ দেশে ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিচার হয়।
এ আইনের ৯(১) ধারায় বলা আছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্তি অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
আর ৯(২) ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
জানতে চাইলে রোববার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০’ সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড করার সুপারিশ করা হয়েছে।
আজ সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ প্রস্তাবটি তোলা হবে। প্রস্তাবে বিদ্যমান আইনের ৯(১) ধারায় পরিবর্তন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আইনটি পাস হলে তা শুধু প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য শিশু আইন-২০১৩’র বিধান অনুসরণযোগ্য হবে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড করা হলে ধর্ষক তথা অপরাধীদের ওপর একটা মানসিক চাপ সৃষ্টি হবে।
অপরাধীরা এ ধরনের জঘন্য অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত হবে। কঠোর আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই ধর্ষকদের নিরুৎসাহিত করতে হবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা সত্য যে এ আইনের মামলা অজামিনযোগ্য ধারায় বিধায় অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে হয়রানির জন্যও মামলা করার নজির রয়েছে।
তবে হয়রানি রোধে নতুন আইনে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর জন্যও মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকাটা ততটা যৌক্তিক হবে না। কারণ এমন বিধান থাকলে ধর্ষণের শিকার হয়েও ভুক্তভোগী মামলা করতে চাইবে না।
মামলায় হেরে গেলে অর্থাৎ মামলাটি মিথ্যা প্রমাণ হলে ভিকটিমেরও মৃত্যুদণ্ড হতে পারে- এমন শঙ্কায় কেউ মামলায় আগ্রহী হবেন না।
আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধানই কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। প্রথমত, শাস্তি যত বেশি হয়, বিচারক আসামিদের শাস্তি দিতে তত ইতস্তত করেন- এটা প্রমাণিত।
এছাড়া আমাদের দেশে ধর্ষণের মামলার সাজার হার মাত্র ৩ শতাংশ। মাত্র দুটি কাজ করলেই এ হার বেড়ে যাবে। একটি হল- পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন ক্যাডারের লোক নিয়োগ দিতে হবে।
তাহলে তারা মামলা সম্পর্কে ধীরে ধীরে অভিজ্ঞ হয়ে ভুক্তভোগীদের সুবিচার দিতে পারবেন। আর পুলিশকে সাক্ষী হাজিরের ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগী হতে হবে। এ দুটি কাজ করলেই ৩ ভাগ থেকে উন্নীত হয়ে ৫০ ভাগ মামলায় সুফল পাওয়া সম্ভব।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের বিধিমালা নেই, তা বানাতে হবে। আর ট্রাইব্যুনালের জবাবদিহিতা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে।
এছাড়া ধর্ষণ মামলা মনিটরিংয়ের জন্য একটা টাস্কফোর্স থাকতে হবে। তিনি বলেন, আমরা কোনো মতেই চাই না যে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড হোক। আর মৃত্যুদণ্ডের বিধান তো আছেই। ধর্ষণজনিত হত্যায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখতে হলে শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা যেতে পারে। তবে মৃত্যুদণ্ড কোনো সমস্যার সমাধান নয়। একজন মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হলে অনেক কিছু ভাবতে হবে।
যে আইনের প্রয়োগ হবে না, শুধু ভয় দেখানোর জন্য এমন আইন দরকার নেই। এসবের চেয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল- দ্রুত বিচারের মাধ্যমে ধর্ষণের মামলার শাস্তিগুলোকে দৃশ্যমান করা।
এছাড়া পুরনো সাক্ষ্য আইনে মেয়েদের যেভাবে হেয় করা হয়- সংশোধনীতে ওইসব জিনিসগুলো বাদ দিয়ে যুগোপযোগী করা যেতে পারে। সরকার যদি চায়, দু-তিন মাসের মধ্যেই ধর্ষণ মামলার বিচার নিষ্পত্তি করা সম্ভব।
শুধু পরিকল্পা করলেই চলবে না। পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলো দেখভালের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশ গণতন্ত্রিক দেশ। আমরা যারা সংশোধন চাই তারা মনে করি, মানুষকে সংশোধন করা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। অপরাধী না হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা করা দরকার।
শাস্তি এমন হওয়া উচিত যে, শাস্তির ভেতরে অপরাধী যেন তার ভুল বুঝতে পারে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ধর্ষণ মামলায় যখন কোনো বাদী বা ভুক্তভোগী আপস করে অথবা মিথ্যা মামলা প্রমাণিত হয়; তখন কোর্ট নিজ উদ্যোগে বাদীর বিরুদ্ধে মামলা করবে।
এ ধরনের নজির নেই বললেই চলে। এমন হলে এ আইনের অপব্যবহার অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
প্রস্তাবে যা থাকছে : আজ মন্ত্রিসভায় বৈঠকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যে সংশোধনীর প্রস্তাব উত্থাপন করা হচ্ছে, সেখানে বলা হয়েছে- ১. নারী বা শিশু ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার এবং নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধগুলো কঠোরভাবে দমনের উদ্দেশ্যে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (২০০০ সালের ৮নং আইন) প্রণয়ন করা হয়।
২. আইনটি ইতোমধ্যে ২০০৩ সালে (২০০৩ সালের ৩০নং আইন) দ্বারা কতিপয় ধারা সংশোধন করা হয়।
৩. নারী ও শিশু নির্যতন দমন আইন-২০০০ এর ধারা ৯-এর উপধারা (১) এ বিধান রয়েছে যে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
৪. সমাজে নারী ও শিশু নির্যাতন কঠোরভাবে দমন এবং প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদারকরণের লক্ষ্যে নারী ও শিশু নির্যতন দমন আইন-২০০০ এর ধারা ৯-এর উপধারা (১) এর অধীন ধর্ষণের অপরাধের জন্য ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শাস্তির পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড’ বা ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ প্রতিস্থাপন করে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০’ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৫. যেহেতু বর্তমানে সংসদ অধিবেশনে নেই এবং আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে বলে রাষ্ট্রপতির কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হলে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করতে পারেন। ৬. উপরোক্ত উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২০’ শীর্ষক একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। ৭. প্রস্তাবিত অধ্যাদেশেটি প্রণয়ন করা হলে নারী ও শিশু নির্যাতন কঠোরভাবে দমন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
বার্তা কক্ষ,১২ অক্টোবর ২০২০