প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না।” এ দেশে ‘ধর্মের নামে কোনো বিভেদ’ সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না ‘ মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৪৯তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে ১৫ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন,
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান – সকল ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। যার যার ধর্ম পালনের অধিকার এ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের আছে।
“এ বাংলাদেশ লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ শাহজালাল, শাহ পরাণ, শাহ মখদুম, খানজাহান আলীর বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ; সাড়ে ষোল কোটি বাঙালির বাংলাদেশ। এ দেশ সকলের।
“এ দেশে ধর্মের নামে কোনো ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে আমরা দেব না। ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এ দেশের মানুষ প্রগতি, অগ্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবেন।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের ইতিহাস প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তুলে ধরেন।
স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ব্যস্ত, দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তখনই পরাজিত শক্তির দোসররা ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট কীভাবে তাকে সপরিবারে হত্যা করেছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে শুধু একজন ব্যক্তি মুজিবের মহাপ্রয়াণ হয়নি। তাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস চালানো হয়; বাঙালি জাতির যে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল, তা স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।
“জাতির পিতা শুধু একজন খাঁটি মুসলমানই ছিলেন না, তিনি ধর্মীয় আচারাদি নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিপালন করতেন। তার মতো আর কে বাংলার মানুষের মন-মনন-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারত!
“তাই তিনি যখন সংবিধান রচনা করেন, তখন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র – এই চারটি মৌলিক বিষয়কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন।”
কিন্তু ১৯৭৫ এর পর বাংলাদেশের উল্টোযাত্রার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিজেদের আসন চিরস্থায়ী করার পদক্ষেপ করে। সামরিক জান্তা সঙ্গীনের খোঁচায় সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধারাবাহিক অপপ্রচার চালিয়ে, ইতিহাস বিকৃত করে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কালিমা লেপনের চেষ্টা করে।”
শেখ হাসিনা বলেন, ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী জাতির পিতা ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা এবং প্রসারে যা করেছেন, ‘ইসলামের নামে মুখোশধারী সরকারগুলো’ তা কখনই করেনি।
পরে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার এবং প্রসারে’ যত কাজ হয়েছে, অতীতে কোনো সরকারই তা করেনি বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমান সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর কথা সবিস্তারে তুলে ধরে তিনি বলেন, “তথাপি ১৯৭১ এর পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে ইদানিং মাঠে নেমেছে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।
“জাতির পিতা ১৯৭২ সালে বলেছিলেন ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করতে। কিন্তু পরাজিত শক্তির দোসররা দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণের শুরুতেই দেশের সকল নাগরিককে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানান।
তিনি বলেন, “ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে আজ আমরা বিজয় দিবস-২০২০ উদযাপন করতে যাচ্ছি। এ বছর আমরা আমাদের মহান নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। কয়েকদিন পর আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পন করব।
“আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছি। গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করে সমগ্র বিশ্বের বুকে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছি। প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে নিজেদের অর্থায়নে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে দেশের দুই প্রান্তকে সংযুক্ত করেছে।”
জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পৃথিবীর বুকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রত্যয় নিয়ে দেশ এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের সকল নাগরিককে আমি বিজয় দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।”
সরকারপ্রধান তার ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ‘সশ্রদ্ধ সালাম’ জানান।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ঘাতকদের হাতে নিহত পরিবারের সদস্যদের কথাও প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, “আজকের এই মহান দিনে আমি মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানকারী বিভিন্ন দেশ ও দেশের জনগণ, ব্যক্তি এবং সংগঠনের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বীর সদস্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাদের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
“কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ভারতের তৎকালীন সরকার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সর্বোপরি সাধারণ জনগণকে- যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন।”
করোনাভাইরাসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে এ বছর যে রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, বরেণ্য ব্যক্তিসহ সর্বস্তরের মানুষ মারা গেছেন, তাদের সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন শেখ হাসিনা।
এ বছর মহামারীর বাস্তবতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বছর আমাদের বিজয় দিবস উদযাপন করতে হচ্ছে। করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে আমাদের দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীতে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে, জনসমাগম এড়িয়ে আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করতে হচ্ছে।”
প্রতিটি মানুষের জীবনই যে ‘মূল্যবান’, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কোনো অবহেলায় একজন মানুষেরও মৃত্যু কাম্য নয়। তাই, আমি সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিজয় দিবস উদযাপনসহ যাবতীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
“আপনারা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরিধান করবেন এবং মাঝেমধ্যে হাত সাবান অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করবেন। আপনার সুরক্ষা, সকলের জন্য রক্ষাকবচ।”
কেবল বাংলাদেশ নয়, করোনাভাইরাস মহামারী যে পুরো বিশ্বকে এক মহাদুর্যোগের কবলে ফেলে দিয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতিকে যে এক কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে, সে কথাও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে আমরা সময়োচিত পদক্ষেপ এবং কর্মসূচি গ্রহণ করে এই নেতিবাচক অভিঘাত কিছুটা হলেও সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ আজ একটি ‘সমীহের নাম’। আজকের বাংলাদেশ আর অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশ নয়। আজকের বাংলাদেশ স্বাবলম্বী বাংলাদেশ।
“জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। আমরা তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।”
‘লাল-সবুজের অসম্মান হতে দিও না’
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনের মধ্যে যখন তার ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা হচ্ছে, তখন মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার প্রত্যয় আবার উচ্চারিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে।
তিনি বলেন, “বিজয় দিবসের প্রাক্কালে তাই আসুন, আবারও আমরা শপথ নেই – আমরা যেন লাখো শহীদের রক্তের ঋণ ভুলে না যাই। আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে না দিই।
“যুবশক্তি, তরুণ সমাজ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে অনুরোধ, তোমরা তোমাদের পূর্বসূরীদের আত্মোৎসর্গের কথা কখনোই ভুলে যেও না। তাদের উপহার দেওয়া লাল-সবুজ পতাকার অসম্মান হতে দিও না।”
এই বিজয় দিবসে নতুন প্রজন্মকে ‘যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে’ পূর্বপুরুষের বিজয়-নিশান সমুন্নত রাখার শপথ নিতে বলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “প্রতিজ্ঞা কর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশকে সোনার বাংলাদেশে পরিণত করবে। তবেই ৩০ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ হবে।”
ঢাকা ব্যুরো চীফ, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০