জাতীয়

ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ : দম ফেলার ফুসরত নেই

গত নয় দিনে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র শুধু ইলিশ মাছ থেকে সরকারের আয় হয়েছে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ভেতরের শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিক্রিকৃত এসব ইলিশ প্যাকেট করতে। অন্যদিকে আরেক দল শ্রমিক প্যাকেট করা এসব ইলিশ তুলে দিচ্ছিল ট্রাকে। ঘাট শ্রমিক থেকে শুরু করে পাইকার পর্যন্ত দম ফেলার ফুসরত নেই যেন কারোরই।

মা ইলিশ রক্ষার্থে ১৫ দিন ইলিশ শিকারের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষে বঙ্গোপসাগরসহ বরগুনার পায়রা বিষখালী ও বলেশ্বর নদীতে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালি ইলিশ।

এই ইলিশ বিক্রিকে কেন্দ্র করে সরগরম হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে। ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার জেলে, ঘাট শ্রমিক আড়তদারসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকাররা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গভীর সমুদ্র থেকে ইলিশ শিকার করে আসা ট্রলারগুলো সারিবদ্ধভাবে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে নোঙর করে আছে। নোঙর করা প্রতিটি ট্রলারের খন্দ (ট্রলারে মাছ সংরক্ষণ করার বাক্স) থেকে দু’তিন জন জেলে শিকার করা ইলিশ মাছ বের করে দিচ্ছেন। অন্য জেলেরা এই মাছ থেকে ছোট ও বড় ইলিশ পৃথক করে ঝুড়িতে তুলে দিচ্ছেন। এসব ঝুড়ি ঘাট শ্রমিকরা মাথায় করে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। আর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ভেতরের শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিক্রিকৃত এসব ইলিশ প্যাকেট করতে। অন্যদিকে আরেক দল শ্রমিক প্যাকেট করা এসব ইলিশ তুলে দিচ্ছিল ট্রাকে। ঘাট শ্রমিক থেকে শুরু করে পাইকার পর্যন্ত দম ফেলার ফুসরত নেই যেন কারোরই।

পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাট শ্রমিক শাহ আলম (৪০) জানান, ইলিশ শিকারের নিষেধাজ্ঞার সময় মানবেতর জীবন-যাপন করেছেন তিনি। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বন্ধ থাকায় বেকার সময় কাটাতে হয়েছে তাকে। ওই সময় পরিবার পরিজন নিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার যোগাতেই হিমশিম অবস্থা ছিল তার।

পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আরেক ঘাট শ্রমিক মনির (৩০) জানান, এই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছ বিক্রি করতে আসা ট্রলারগুলোর মাছ টেনে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাদের। সারা বছর এই কাজ করেই তারা সংসার পরিচালনা করেন। ছেলে-মেয়েদের স্কুলের বেতনও পরিশোধ করেন এ কাজ করেই। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় গত ১৫ দিন কোনো কাজ পাননি তিনি।

পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাট শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলদস্যু সমস্যাসহ নানা কারণে বছরের বেশিরভাগ সময়ই জেলেদের নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে মাছ শিকার করতে হয়। তাই দিনে দিনে এসব জেলে শ্রমিকরা দারিদ্রের বেড়াজালে আটকে পড়ছে।

সোহেল আরো জানান, এখানকার বেশিরভাগ শ্রমিক প্রতিদিনের রোজগার দিয়েই তাদের সংসার পরিচালানা করেন। মাছ সরবরাহ ভালো থাকলে তাদের আয়ও ভাল হয়। সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারগুলো মাছ নিয়ে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে বিক্রি করতে আসা শুরু করেছে। তাই বর্তমানে এখানে ইলিশের সরবরাহ ভালো। এই সুযোগে হয়তো এখানকার জেলে শ্রমিকরা কিছুটা পিছুটান কাটিয়ে উঠতে পারবে।

উপকূলীয় এলাকায় দু’শ্রেণির জেলে। এর মধ্যে এক শ্রেণি গভীর সমুদ্রের ও অন্যরা প্রান্তিক জেলে। উভয় প্রকার জেলেদের জীবন-জীবিকা পুরোপুরি মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল। প্রান্তিক জেলেরা বরগুনার প্রধান তিনটি নদ পায়রা বলেশ্বর ও বিষখালীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রজনন মৌসুমের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় এখন প্রান্তিক জেলেদের জালেও ধরা পড়ছে ইলিশ।

পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা এলাকার জেলে আবদুস ছালাম (৪০) জানান, এখন নদীতেও ভালো মাছ পাওয়া যাচ্ছে। তবে গত বছরের তুলনায় এবছর বড় ইলিশের পরিমাণ কম। অধিকাংশ মাছই মাঝারি আকারের ইলিশ। বাজারে ইলিশের চাহিদা ভালো থাকায় দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

বরগুনার তালতলী উপজেলার তালতলী, বগী, পচাঁকোড়ালিয়া ও পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা, কাকচিড়া, কালমেঘা এবং সদর উপজেলার চালিতাতলী, পুরাকাটা ও নলী বাজার ঘুরে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব এলাকায় ইলিশের বাজার আবারও জমজমাট হয়ে উঠেছে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর এসব এলাকার জেলেদের জালে ভালোই ইলিশ ধরা পড়েছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অন্য সময়ের চেয়ে এখন বাজারে ইলিশের ব্যাপক সরবরাহ রয়েছে। ক্রেতাদের আনাগোনাও বেশ ভালো। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাক-ডাকে এখন মুখরিত এসব বাজার। একজন প্রান্তিক জেলে গড়ে প্রতিদিন ১৫শ থেকে দু’হাজার টাকার মাছ পাচ্ছেন।

তালতলী উপজেলার বগী ইউনিয়নের জেলে ইউসুফ (৩৫)  জানান, এখন আর মাছ ধরতে বাধা নেই তাদের। নিষেধাজ্ঞার সময় পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটিয়েছেন তিনি। নদীতেও এখন প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। এভাবে ইলিশ ধরা পড়লে সংসারে আর কোনো অভাব-অনটন থাকবেনা বলেও জানান তিনি।

পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া ইউনিয়নের জেলে শাশীম (২৫) জানান, স্থানীয় প্রভাবশালীরা এ বছর প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতের বেলায় মা ইলিশ শিকারের উৎসবে মেতেছিল। মা ইলিশ রক্ষার জন্য মৎস্য বিভাগ দিনের বেলায় নদীতে অভিযান পরিচালনা করলেও রাতের বেলায় কোনো অভিযান পরিচালনা করেননি তারা। ফলে রাতের বেলায় অসাধু জেলেরা অনেক মা ইলিশ শিকার করেছে বলেও জানান তিনি।

বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বঙ্কিম চন্দ্র বিশ্বাস জানান, ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ। একে রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে এর উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব।

তিনি বলেন, এ বছর সকলের প্রচেষ্টায় অন্য বছরের চেয়ে বহুগুণে মা ইলিশ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ফলে আগামী দিনে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

তিনি আরও বলেন, গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশের প্রজননের সময় সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মা ইলিশ শিকার করায় তিন শতাধিক জেলেকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ জাল। নিষেধাজ্ঞা শেষ হতেই জেলেরা নদীতে নেমে পড়েছেন ইলিশ শিকারে। এখন তাদের জালে ভালোই মাছ ধরা পড়ছে বলেও জানান তিনি।

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, সাগরের সব জায়গায় সমান মাছ পাওয়া যায় না। যে সব জায়গায় তুলনামূলক বেশি মাছ পাওয়া যায়, সে সব যায়গায় জলদস্যু ও বিদেশি ট্রলারের উৎপাতে আমাদের জেলেরা মাছ ধরতে পারেনা। ফলে সাগরে প্রচুর মাছ থাকা সত্ত্বেও আমাদের জেলেরা তুলনামূলক কম মাছ পাচ্ছেন।

তিনি আরো বলেন, জলদস্যু ও বিদেশি ট্রলার বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও এর কোনো সমাধান হয়নি। যার ফলে মৎস শিল্প দিন দিন ধংসের মুখে যাচ্ছে। এছাড়া সুদীর্ঘ বছর ধরে জলদস্যু সমস্যা তো রয়েছেই।

বরগুনার জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর জেলায় সফলভাবে মা ইলিশ নিধন রোধ করতে সম্ভব হয়েছেন তারা। নিষেধাজ্ঞার ১৫ দিন সার্বক্ষণিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারাসহ পুলিশ ও মৎস্য বিভাগের লোকজন ব্যস্ত ছিল মা ইলিশ রক্ষার কাজে। এ ক্ষেত্রে কাউকেই কোনো ছাড় দেয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।

প্রশাসনকে ম্যানেজ করে মাছ ধরার অভিযোগ সম্পর্কে জেলা প্রশাসক বলেন, এমন অভিযোগ সত্য নয়।

এদিকে, পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এম সোলায়মান শেখ জানান, ইলিশ শিকারের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর গত নয় দিনে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে শুধু ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৯৯ টন (১০ অক্টোবর থেকে ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত)। যার মূল্য ছিল চার কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সরকার এই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে বিক্রিত মাছের উপর শতকারা ১.২৫ টাকা রাজস্ব আদায় করে। সে হিসেবে গত নয় দিনে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র শুধু ইলিশ মাছ থেকে সরকারের আয় হয়েছে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০৫:৩৪ পিএম,২৫ অক্টোবর ২০১৫, রোববার

 এমআরআর

Share