আশ্রয়ণ প্রকল্পে এ পর্যন্ত ৯ লাখ ৫৩ হাজার ৬’শ সাতটি পরিবারকে ঘর দিয়েছে সরকার। গতবছরের জুন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ছয় ’শ ২২টি। মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেয়া হয়েছে ৬৭ হাজার ৯’শ ৮৫টি।
গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারগুলোকে নানা ক্যাটাগরিতে ঘর দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে যেমন বাঙালি পরিবার রয়েছে,তেমনি আছে পাহাড় ও সমতলের নৃ-গোষ্ঠীরাও। ভিক্ষুক,হরিজন,হিজড়াসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষও পেয়েছে ঘর।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক মাহবুব হোসেন বলেন,‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পাশাপাশি ভূমি মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এসব ঘর দেয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প এককভাবে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ঘর প্রদান কর্মসূচির সমন্বয় করছে।’
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পরিদর্শন করেন এবং ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার দানকৃত জমিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প নেয়া হয়। যা এখন প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ব্যারাক নির্মাণের কাজ সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের মাধ্যমে ‘যার জমি আছে ঘর নেই,তার নিজজমিতে গৃহনির্মাণ’ নামের কাজটি উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
মুজিববর্ষের বিশেষ কার্যক্রম
মুজিববর্ষ উপলক্ষে আলাদা করে গৃহনির্মাণ উপযোগী ২ শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদান করে প্রথম পর্যায়ে ৬৭,৯৮৫টি পরিবারের জন্য ঘর বানিয়ে দেওয়া হয়। এপ্রিলের মধ্যে আরও ৫০ হাজার ঘর হস্তান্তর হবে। অন্যদিকে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ২১টি জেলার ৩৬টি উপজেলার ৪৪টি প্রকল্প গ্রামে ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণের মাধ্যমে ৩,৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার হিসেবে কক্সবাজার জেলার খুরুশকুল এলাকায় বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মিত পাঁচতলা বিশিষ্ট ২০টি বহুতল ভবনে প্রথম পর্যায়ে ৬০০টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। ৪০৬ বর্গফুট আয়তনের একটি করে ফ্ল্যাট পেয়েছে পরিবারগুলো। এ প্রকল্পের আওতায় ৫-তলা বিশিষ্ট মোট ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ৪৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে।
হিজড়া সম্প্রদায়ের পুনর্বাসন
দেশের দুটি জেলায় হিজড়া তথা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর একটি সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায় বাস্তবায়িত হাটিকুমরুল আশ্রয়ণ প্রকল্প। প্রকল্পটিতে ৪টি সেমিপাকা ব্যারাকে ২০টি তৃতীয় লিঙ্গের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। যা প্রধানমন্ত্রী গত ২৩ জানুয়ারি উদ্বোধন করেছেন। হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে দেয়া হয়েছে পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও ঋণ। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনাশিপের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে গরুর খামার ও সেলাইঘর। তাছাড়া হাঁস-মুরগি,কবুতর পালন ও শাকসবজি উৎপাদনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।
এর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে দিনাজপুরের সদর উপজেলায় বাঙ্গিবেচা ব্রিজসংলগ্ন মানবপল্লী নামে বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৫ ইউনিট বিশিষ্ট ২৫টি ব্যারাকে ১২৫ জন তৃতীয় লিঙ্গের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল।
কুষ্ঠরোগীদের জন্য বান্দাবাড়ী প্রকল্প
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২০০০ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকার প্রায় ৬০ কি.মি. দূরে ভাওয়ালের গজারি বনে ঘেরা কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের বান্দাবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঠাঁই পায় কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত বেশকিছু পরিবার। প্রকল্পটি হওয়ার আগে যাদের ঠিকানা ছিল কমলাপুর স্টেশন এবং আগারগাঁওয়ের বস্তি। প্রকল্পটিতে ৭টি ব্যারাকে ৭০টি গৃহহীন কুষ্ঠরোগীকে পরিবারসহ পুনর্বাসন করা হয়।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য ঘর
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলায় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৮টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবার ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে একই জেলার লংগদু উপজেলার ১৭৬টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারকে বিশেষ নকশার ঘর বানিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে ৩৬৬টি বিশেষ নকশার ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও মুজিববর্ষে রাঙ্গামাটির ৭৩৬টি, বান্দরবানের ২,১৩৪টি এবং খাগড়াছড়ির ৯৬৮টি গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলায় রাখাইন সম্প্রদায়ের পরিবারের জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০টি টং ঘর বানিয়ে দিয়েছে সরকার।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের নিভৃতপল্লী চাঙ্গুড়া গ্রামে ৫০টি সাঁওতাল পরিবারকে ঘর ও জমি দেওয়া হয়েছে। দিনাজপুরের খানসামায় মুজিববর্ষ উপলক্ষে ১০টি পরিবারকে ‘আধা পাকা ইটের বাড়ি’ উপহার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসব বাড়ি হস্তান্তর করা হয়।
রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলায় কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর বড়গোলা গ্রামে ২৫টি পাটনি পরিবার পেয়েছে দু’ক্ক্ষবিশিষ্ট পাকা ঘর। প্রতি পাঁচ পরিবারের জন্য বানিয়ে দেয়া হয়েছে একটি করে শৌচাগার।
কয়লাখনির ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পুনর্বাসন
দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ৩১৮টি পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দক্ষিণ পলাশবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৬৪টি পাকা ব্যারাক নির্মাণ করে ৩১৮টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
ভিক্ষুক ও হরিজন পুনর্বাসন
ভিক্ষুক পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার ভিক্ষুকদের জন্য ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৬৯১টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া নড়াইল জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণার অংশ হিসেবে নড়াইল জেলার ৩ উপজেলায় (২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছর) ৩১১টি পরিবার এবং মুজিববর্ষে আরও ২২ টিসহ ৩৩৩টি ভিক্ষুক পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
নীলফামারীর সদর উপজেলায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২টি ৫ ইউনিট বিশিষ্ট সিআই সিট ব্যারাক নির্মাণ করে হরিজন সম্প্রদায়ের ৬০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে বলেন,‘জলবায়ু উদ্বাস্তু, ভূমিহীন ও গৃহহীনরা সবাই পর্যায়ক্রমে ঘর পাবে। যাদের জমি নেই তাদের দু’শতাংশ জমির দলিলও বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে।’
বার্তা কক্ষ , ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
এজি