৪৮ বছরে দেশে সবজি উৎপাদন পাঁচগুণ বেড়েছে। আর বার্ষিক উৎপাদন বৃদ্ধির হার বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। উৎপাদনে বিল্পব ঘটলেও দেশে সবজির ঘাটতি যেমন আছে তেমনি খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও সংশয়মুক্ত নয়। সংরক্ষণের অভাবে অনেক সবজি নষ্টও হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আবাদি জমি সাড়ে ৮ মিলিয়ন হেক্টর। এর সিংহভাগে দানাদার শস্য চাষ হয়। আবাদির মাত্র ৯ ভাগ জমিতে সবজি চাষ করা হচ্ছে। এতে গড়ে মাথাপিছু প্রতিদিন ১২৫ গ্রাম সবজি পাওয়া যাচ্ছে।
২০০৬ সালে দেশে সবজি উৎপাদন হয় ২০ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। সেখানে গেল ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেড় কোটি মেট্রিকটন সবজি উৎপাদন হয়েছে। দেশের উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলে সবজি চাষে সবচে বেশি সাফল্য এসেছে। হাইব্রিড বীজ ও সারের ব্যবহার বিপ্লবের কারণ। লাভও বেশি, তাই চাষিরা আগ্রহী হচ্ছে সবজিতে। চাষে এখনো সনাতনী পদ্ধতির ব্যবহার আছে অনেক জায়গায়। কারণ কৃষক পর্যায়ে সর্বত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি।
দেশের গবেষকরা বীজ উৎপাদনে কিছু সফলতা পেলেও সবজির হাইব্রিড বীজ এখনো আমদানিনির্ভর। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গবেষণার ধারাবাহিকতা রক্ষার পরামর্শ রয়েছে। রাসায়নিক ব্যবহারে কৃষকদের সচেতন করা হয়নি। ফলে সবজি চাষে স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি নিশ্চিতভাবে দূর করা যায়নি।
সবজি চাষেও এসেছে পরিবর্তন। উন্নত জাতের বীজ, সার, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে কৃষকরা বছরজুড়েই উৎপাদন করছে বহু সবজি। কিছু এলাকায় সর্জন ও ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরু হয়েছে। শহরে হচ্ছে ছাদ কৃষি, যদিও তা সৌখিন। নতুন ভাবনাও আছে কৃষি গবেষকদের।
সবজি চাষের ক্ষেত্রে সংগ্রহত্তোর অপচয় এখনো রোধ করা সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞদের অভিমত উৎপাদনের শতকরা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সবজি এখনো মাঠেই নষ্ট হয়। যা রোধ করা সম্ভব হলে উৎপাদন ঘাটতি কমানো সম্ভব হবে।
দেশে ৯০ রকমের সবজির বাণিজ্যিক চাষ
সাড়ে সাত কোটি থেকে বেড়ে ৪৮ বছরে দেশে মানুষ হয়েছে ১৬ কোটি। ছোট্ট দেশে এত মানুষের খেয়ে-বেঁচে থাকার সবচে বড় সম্বল কৃষি। তাই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে হচ্ছে কৃষিকে। যেন প্রতিদিন বিপ্লব করার পরীক্ষা, যার বিপ্লবীরা কৃষক। কৃষিতে চমক জাগানো নানা অগ্রগতির উল্টো পিঠে আছে দুঃখ-গাঁথা আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও সংগ্রামের কথা।
দেশে সবজির চাষ এক সময় মূলত পরিবারকেন্দ্রিক ছিল। বাড়ির কর্তা ও গৃহিণীরাই বাড়ির আঙিনা ও চারপাশে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজির লাগাত। পরিবার, প্রতিবেশীরা খেত, বাঁচলে বাজারে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করত।
আশির দশক থেকে পাল্টাতে শুরু করে সবজি চাষের চিত্র। ভাত, ডাল, মাছ মাংসের পাশাপাশি শরীরের পুষ্টির জন্য সবজিও যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সেটার প্রয়োজনীতা বুঝতে শুরু করে শহুরে মানুষেরা। সবজির চাহিদা বাড়ে, বাড়তে শুরু করে চাষ এবং উৎপাদন।
দানাদার শস্যের মতো বিগত কয়েক দশকে সবজিরও বাণিজ্যিক চাষ দেশজুড়ে শুরু হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, দেশে ৯০ রকমের সবজির বাণিজ্যিক চাষ হয়, যার ৩০ থেকে ৩৫টি প্রধান। কোনো সবজি বিলুপ্তি হয়নি বরং যেসব এক সময় খাওয়ার চিন্তা করেনি কেউ তা এখন গুরুত্ব দিয়ে চাষ হচ্ছে। আধুনিকায়নের কারণে অনেক মৌসুমী সবজি সারা বছর চাষ হচ্ছে।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, দেশে দেড় হাজারের বেশি ঔষধী গাছ থাকলেও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঔষধী গাছ চাষে সাফল্য তোলা যায়নি, তাই আমদানিনির্ভর।
চাহিদার তুলনায় অর্ধেক সবজি উৎপাদন
এক দশকে উৎপাদন দ্বিগুণ হলেও চাহিদার তুলনায় অর্ধেক সবজি উৎপাদন হচ্ছে প্রতি বছর। দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে চাষের জমি বাড়ানো হলে সবজি অর্থকরি ফসল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা। যা দানাদার শষ্যের প্রতি চাপ কমাবে বলে গবেষকদের ধারণা।
চাহিদার তুলনায় ঘাটতি থাকায় সবজি নিয়ে নানা পরিকল্পনা এবং গবেষণার চেষ্টা চলছে। সবজি বিভাগ উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র এখন পর্যন্ত ৩৪টি সবজির ১০৭টি জাত অবমুক্ত করেছে। যার মধ্যে ৯২টি উন্মুক্ত পরাগায়িত এবং ১৫টি হাইব্রিড। এ ছাড়াও হাইব্রিড বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানান গবেষকরা।
সবজির ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত কৃষক
দেশে সবজির ক্রমবর্ধমান বাজার টাকার অংকে কত বড় তার হিসেব নেই কোথাও। তবে প্রতি বছর বিশ্বের পঞ্চাশটি দেশে প ৭০০ কোটি টাকার সবজি রপ্তানি হয়। এ তালিকায় নেই ওষধি গাছ। রপ্তানির জন্য কিছু এলাকায় পরিকল্পিতভাবে সবজির চাষ হচ্ছে। মুষ্টিমেয় কিছু কৃষক ছাড়া অধিকাংশ কৃষক উৎপাদিত সবজির ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।
ঢাকার অদূরে গ্রামীণ হাটে চাষিদের তাজা সবজির যে দাম, ঢাকায় এসেই তার দাম হচ্ছে কমপক্ষে তিনগুণ বেশি। লাভের বড় অংশ পাচ্ছেন না চাষি । কিন্তু ভোক্তারা সবজি কিনছে উচ্চমূল্যে। উৎপাদিত সবজির ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ফসল নষ্ট করার মতো ঘটনাও দেখা যায় এ খাতে। লাভের মূল অংশ নিয়ে যায় যে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাদের আছে নানা ব্যাখ্যা। সবজি চাষিদের জন্য ব্যাংক ঋণের পৃথক সুযোগ না থাকায় আছে কৃষকদের আক্ষেপ।
বার্তা কক্ষ
৯ জুলাই ২০১৯