সম্প্রতি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়। জানা যায়, উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের কাশারিয়ারঘাট গ্রামের মশিউর রহমানের ছেলে বেলাল হোসেন (৭) এবং রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার রবিউল ইসলামের মেয়ে রোকাইয়া খাতুন (৮), তারা মামাতো-ফুফাতো ভাইবোন। শিশু রোকাইয়া খাতুন তার মায়ের সঙ্গে মামাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে এ দুর্ঘটনায় শিকার হয়। ঘটনার দিন বিকালে তারা দু’ ভাইবোন বাড়ির পাশে খেলছিল। হঠাৎ বামনি খালের পানিতে গোসল করতে নামে শিশু বেলাল ও রোকাইয়া। একসময় স্থানীয়রা খালের পানিতে তাদের মরদেহ ভাসতে দেখে।
এভাবে প্রতি বছর পানিতে ডুবে অসংখ্য শিশুর মৃত্যু হচ্ছে, যা শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ। বর্ষাকালে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু বেড়ে যায়। চারদিকে পানি বাড়ে, সে সময় দুর্ঘটনাগুলো বেশি হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মৃত্যু প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বয়স্কদের তত্ত্বাবধান বাড়াতে হবে। গ্রামে শিশু পরিচর্যাকেন্দ্র রাখতে হবে। অতি দরিদ্রতা, পুকুর-জলাধারে নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাব দূর করতে হবে, শিশুদের সাঁতার শেখাতে হবে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ১৭ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এ মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। যা মোট শিশুমৃত্যুর ২৮ ভাগ। এই মৃত্যুর বেশির ভাগ খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, বছরে ১ থেকে ১৭ বছর বয়সি ১৪ হাজার ৪৩৮ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। শিশু ও কিশোরদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া, যা বর্তমানে একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট বলে জানান বিজ্ঞজনেরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়, যার ৯০ শতাংশ ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। বৈশ্বিক তথ্য অনুযায়ী, পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মারা যায় এক থেকে চার বছরের শিশুরা এবং দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ বয়স হলো পাঁচ থেকে ৯ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেয়ে শিশুদের তুলনায় দ্বিগুণ ছেলে শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। তারা বলেছেন, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে সরকারি ছাড়াও এনজিও, কমিউনিটি অরগানাইজেশন ও বেসরকারি খাতের কার্যক্রম এখনো সীমিত। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণ কৌশল বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ ও অবদান জরুরি।
পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহারযোগ্য। সরকার পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু যত্নকেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ নামে প্রকল্প নিয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তিন বছরমেয়াদি এ প্রকল্পের আওতায় এক থেকে পাঁচ বছর বয়সি ২ লাখ শিশুর জন্য ৮ হাজার সমাজভিত্তিক শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করার কথা। প্রতিটি কেন্দ্রে ২৫ জন শিশুকে ভর্তি করা হবে। সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত শিশুরা ঐ কেন্দ্রে থাকবে। এতে কর্মসংস্থান হবে ১৬ হাজার গ্রামীণ নারীর। ২৭১ কোটি ৮২ লাখ টাকার প্রকল্পটি গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদিত হয়।
প্রকল্প অনুযায়ী, ১৬ জেলায় এর কাজ চলবে। আর এসব পরিচালনা করবে স্থানীয় এনজিওগুলো। কিন্তু প্রকল্পের ১৫ মাস পরেও কেবল ১৬ জেলায় ১৬ কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন। এনজিওগুলোও কাজ শুরু করেনি। প্রকল্প পরিচালকও এখনো নিয়োগ হয়নি। এ প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. তারিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ার পর মে মাসে মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ পাওয়া যায়। কিছুটা সময়ক্ষেপণ তো হয়েছেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) শিশুদের ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে ১০টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। এগুলো হলো শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, সাঁতার শেখানো ও প্রাথমিক চিকিত্সা। ডব্লিউএইচওর তিন ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সিআইপিআরবির অভিজ্ঞতা থেকেই নেয়া।
২০১৮ ও ২০২১ সালে দু’ সময়েই পাঁচ বছর বয়সি শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল নিউমোনিয়া।
গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’। সংগঠনটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে। সংগঠনটির হিসাবে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত, এ তিন বছরে পানিতে ডুবে ৩ হাজার ২৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর ৮৭ শতাংশই শিশু। সংগঠনটির শুধু সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এই তথ্য জানায়। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চের (সিআইপিআরবি) নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান বলেন, গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি বছর পাঁচ বছর বয়সি অন্তত ১১ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। এ মৃত্যুর বড় অংশের খবর পত্রিকায় আসে না।
১০ আগস্ট ২০২৩
এজি