Home / সারাদেশ / দেশে ফিরে বিয়ে করার কথা ছিল ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুরের
বিয়ে
হাদিসুরের বাড়িতে মা-বোন-ভাইয়ের আহাজারি।

দেশে ফিরে বিয়ে করার কথা ছিল ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুরের

‘হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলে ভাইয়ার সঙ্গে আমি যখন কথা বলছিলাম তখন বুধবার রাত সাড়ে আটটা, সম্ভবত কথা বলার জন্যই ভাইয়া জাহাজের ওপরে উঠেছিলেন। ভাইয়া আমার পড়াশোনার খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছিলনা, মায়ের চিকিৎসার খোঁজ নিচ্ছিলেন। সেই সময় হঠাৎ বিকট শব্দ। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমার ধারণা ওই সময়ই জাহাজে রকেট আছড়ে পড়ে আগুন লেগে যায়। পরে সংবাদমাধ্যমে জানতে পারি ওই জাহাজে থাকা আমার ভাই হাদিসুর রহমান নিহত হয়েছেন।’

কথাগুলো বলছিলেন হাদিসুর রহমানের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স। নিহত হাদিসুরের সঙ্গে সবশেষ কথা হচ্ছিল ছোট ভাই প্রিন্সের।

বরগুনা জেলার বেতাগী কদমতলা গ্রামের বাসিন্দা মো. আবদুর রাজ্জাকের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে হাদিসুর দ্বিতীয়। বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে মাধ্যমিক ও বেতাগী সরকারি কলেজ থেকে ২০১০ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। এরপর চলে যান চট্টগ্রাম। ২০১১ সালে চট্টগ্রামের মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হন এবং ২০১৩ সালে মেরিন একাডেমি থেকে প্রকৌশলী হওয়ার পর চাকরিতে যোগ দেন হাদিসুর। ৯ ডিসেম্বর ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে যোগদানের উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকা বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। এ সময় তার ভাই তারিকুল ইসলাম তারিক বিমানবন্দরে বিদায় জানিয়ে আসেন।

আরও পড়ুন….  ‘আর ভাঙা ঘরে থাকতে হবে না’, ছোট ভাইকে বলেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর

হাদিসুরের বাবা আবদুর রাজ্জাক স্থানীয় নাদেরিয়া দাখিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। ২০১৫ সালে তিনি শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নেন। সামান্য বেতনে চাকরি, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাতে যেটুকু জমি-জমা ছিল সব বন্ধক ও বিক্রি করেছেন। সম্বল বলতে বড় ছেলে হাদিসুরের চাকরি ও শুধুমাত্র পুরোনো কাঠের ঘর ছাড়া কিছুই নেই। চাকরিতে যোগদানের পর পরিবার ও দুই ভাইয়ের পড়াশোনা সব মিলিয়ে আর বিয়ের কথা ভাবেননি। ভাই তারিকুল ইসলাম তরিক পটুয়াখালী কলেজ থেকে স্নাতক (সম্মান) শেষ করে স্নাতোকোত্তর করছেন। ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স সাত কলেজের অধীনে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত। অসুস্থ মা বাবার চিকিৎসা ও দুই ভাইয়ের পড়াশোনার সব খরচই চালাতেন হাদিসুর। কথা ছিল এবার বাড়িতে ফিরলে নতুন ঘর নির্মাণ ও বিয়ে করার। পরিবারের সবাই খোঁজখবর করছিলেন।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা হাদিসুরের বাড়িতে গিয়ে অসংখ্য মানুষের ভিড় দেখা যায়। হাদিসুরের বাবা আবদুর রাজ্জাক বলছেন, ‘মোর পোলাডারে মোর দারে এট্টু আইন্না দেন, মুই ওর মুকটা একফির দেহি?’ মেঝেতে বসে বিলাপ করছেন নিহত হাদিসুর রহমানের মা রাশিদা বেগম। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে বাবার বাড়িতে ছুটে এসেছেন একমাত্র বোন সানজিদা আক্তার। বুধবার সকাল আটটার মা রাশিদা বেগমের সঙ্গে সবশেষ কথা হয়। এ সময় বারবার মায়ের শরীরের খোঁজ নিচ্ছিলেন ছেলে হাদিসুর রহমান। তার মা বলছিলেন, ‘মা তুমি বেশি করে খাও আমি দেখব তুমি কতগুলা ভাত খাইতেছ তুমি’।

কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাশিদা বেগম। কান্না থামিয়ে বলেন, ‘মুই আর কিছছু চাই না, মোর পোলাডার মুকটা শ্যাষবারের মতন একটু দ্যাকতে দেন। মোর বাকি দুইডা পোলা আছে, ওগো পড়ালেহা এহন কেডা চালাইবে। মোর শরীররডা ভালোন, ওর বাফেরও অসুখ। জমিজমা টাহা পয়সা বেবাক পোলার পিছে খুয়াইয়া চাকরির পর পোলার কামাই খাইয়া বাইচ্চা আছি। দুইডা পোলার লেহাপড়ার সব খরচা মোর বড় পোলায় দেত। ও মইরা গ্যাছে, এহন মোগেও মরণ ছাড়া উপায় নাই।’

হাদিসুরের ভাই তারিকুল ইসলাম তরিক ‘ভাইয়া তুমি কোম্মে চইল্যা গ্যালা’ কখনো চিৎকার, কখনো ফুপিয়ে আবার কখনো আনমনে বিলাপ করে আহাজারি করছিলেন। তারিক বলেন, ‘ও তো মোগো খালি ভাই না, মোগো অভিভাবক ছিল। এমন একটা দিন যায় নাই যে মোগো খোঁজ খবর নেয় নাই। আমি, ছোট ভাই প্রিন্স ও মা-বাবার খোঁজ নিতেন নিয়মিত। মারা যাওয়ার আগের দিন বুধবার সকালেও আমার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয়েছে। মাকে ডাক্তার দেখাইতে কইছিল, আমি মাকে নিয়া পটুয়াখালী ডাক্তার দেখাইয়া আসছি। মা সুস্থ হইলো আর মোর ভাইয়া মোগো ছাইড়া চইল্যা গ্যালো।’

একমাত্র বোন সানজিদার বিয়ে হয়েছে জেলা আমতলী উপজেলায়। খবর পেয়ে বাবার বাড়িতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সানজিদা বলেন, ‘তিনডা ভাইর আমি একটা বুইন। প্রতিদিনই ও আমার খোঁজ খবর নিত। বিয়ার কথা বলছিলাম, বলছিল, আপা এইবার সেপ্টেম্বর মাসে বাড়িতে আইসা ঘর উডাইয়া বিয়া করমু। আহারে আমার ভাই…।’

নিহত হাদিসুর রহমান বেতাগী উপজেলা চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফোরকানের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। ফোরকার বলেন, ‘রাতে হাদিসুরের নিহত হওয়ার বিষয়টি জাহাজের সহকর্মীদের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছি। হাদিসুরের মরদেহ আনার বিষয়ে বরগুনার দুজন সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপ করেছি। তবে তারা নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারেননি।’

ফোরকান বলেন, ‘হাদিসুর মারা যাওয়া পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে। ওর ছোট দুইভায়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি।’

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘নিহত হাদিসুরের মরদেহ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। এই মুহূর্তে ইউক্রেনে যে অবস্থা চলছে, নিশ্চিত করে আমরা বলতে পারছি না তাঁর মরদেহ কবে নাগাদ আনা সম্ভব হবে।’

গত ২১ ফেব্রুয়ারি ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ নামের জাহাজটি তুর্কি বন্দর এরেগলি ছেড়ে যায়। দুই দিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বন্দর অলিভিয়ায় পৌঁছায়। রাশিয়ার সামরিক অভিযানে ইউক্রেনের পরিস্থিতির অবনতি হলে শিপিং করপোরেশনের নির্দেশে পণ্য লোড করার পরিকল্পনা বাতিল করে সেখানেই জাহাজটিকে অবস্থান করতে বলা হয়।

বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত ৯টা ২৫ মিনিটে যুদ্ধবিমান থেকে রকেট হামলায় বাল্কটির ডেকে আগুন ধরে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন জাহাজের ক্রু ও নাবিকেরা। কিন্তু ওই হামলায় মারা যান জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান।