বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের অব্যাহত দরপতনের মধ্যে এবার দেশে তেলের দাম কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
তার প্রস্তাব অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজার দামের চেয়ে ১০ শতাংশ কম-বেশি করার বিদ্যমান ফর্মুলা প্রয়োগের মাধ্যমে তেলের দেশের বাজার মূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।
একইসাথে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি আন্তঃ মন্ত্রণালয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তার সুপারিশ মতে, ওই কমিটিতে আলোচনার জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে জ্বালানি বিভাগ।
গত ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে দেয়া এক চিঠিতে অর্থমন্ত্রী এ প্রস্তাব দেন।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, অর্থমন্ত্রীর চিঠি পেয়েছি। জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করার ব্যাপারে আমরা সচেতন রয়েছি। ইতিমধ্যে জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের বর্তমান অবস্থা এবং দেশের সার্বিক জ্বালানি চাহিদা ও সরবরাহের বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শিগগিরই প্রতিবেদনটি তৈরির পর তেলের মূল্য সমন্বয়ের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করব। তিনি জানান, দুই-তিন দিনের মধ্যেই প্রতিবেদনটি অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে।
গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। এ ধারা আরো অনেক দিন অব্যাহত থাকবে বলেই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা পূর্বাভাস দিয়েছেন। গত সোমবার প্রতি ব্যারেল (প্রায় ১৫৯ লিটার) অপরিশোধিত তেলের দাম ২৫ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। গত এক যুগে এটি তেলের সর্বনিম্ন মূল্য।
দুই দিন আগে শনিবারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ২৯ ডলার ৪২ সেন্ট। সর্বশেষ ২০০৪ সালে এর দাম প্রতি ব্যারেল সর্বনিম্ন ২৯ ডলার ৫৬ সেন্টে নেমেছিল। এরপর তেলের দাম এতটা কমেনি। ২০০৮ সালে তেলের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ১৫২ ডলারে উঠেছিল। গত পাঁচ বছরে তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে কমেছে ১২৫ থেকে ১২৭ ডলার।
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী (বীর বিক্রম) ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীকে দেয়া চিঠিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে আমাদের কিছু করণীয় আছে।
মনে হচ্ছে যে পেট্রোলের দরপতনটি বেশ কিছুদিনের জন্য স্থায়ী হবে এবং এটা স্বীকার করতেই হবে যে, দরপতন হয়েছে ব্যাপক। আমাদের পেট্রোলিয়ামের জন্য অনেক ভর্তুকি দিতে হয়েছে এবং সেই কারণে পেট্রোল শোধনকারী প্রতিষ্ঠান অথবা পেট্রোল বিতরণ প্রতিষ্ঠান নানাভাবে দুর্ভোগের মধ্যে ছিল।
আমরা সব সময় নিয়মমতো ভর্তুকি দিইনি। তারাও নিয়মমতো কর-ভ্যাট ইত্যাদি আদায় করেনি। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। এখন আমাদের বাজারদর নিয়ে চিন্তা করা যথোপযুক্ত হবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে ১২২ ডলারে উন্নীত হলে বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়।
ওই সময়ে দাম বাড়িয়ে লিটার প্রতি অকটেন ৯৯ টাকা, পেট্রোল ৯৬ টাকা, কেরোসিন ও ডিজেল ৬৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর দুই বছর ধরে জ্বালানি তেলের দাম ধারাবাহিকভাবে কমে ৩০ ডলারের নিচে নেমে এলেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আগের লোকসান ও দেনা কমাতে মূল্য অপরিবর্তিত রাখা হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে তেলের মূল্য সমন্বয় না করায় এখন পর্যন্ত বিপিসি যে মুনাফা করেছে তা দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেয়া সব দেনা পরিশোধ করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি বাবদ দেয়া অর্থের বিপরীতে টাকা চাইলেও এখন পর্যন্ত দেয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বিপিসির চেয়ারম্যান এএম বদরুদ্দোজা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভর্তুকি দেয়া অর্থের পরিমাণ ২৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ টাকা ফেরত দিতে হলে তেলের দাম আরও অন্তত চার বছর বর্তমান পর্যায়ে থাকতে হবে। তেলের মূল্য নির্ধারণ, ভর্তুকিবাবদ দেয়া ঋণ শোধ ও সরবরাহের ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।
জ্বালানি তেলের দাম কমেছে ভারতেও, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি দাম বাংলাদেশে গত ছয় সপ্তাহের মধ্যে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম চতুর্থবারের মতো কমিয়েছে ভারত।
গত রবিবার প্রকাশিত ভারতের দ্যা হিন্দু পত্রিকা জানায়, প্রতি লিটার পেট্রোল ও ডিজেলের দাম যথাক্রমে ৩২ পয়সা এবং ৮৫ পয়সা করে কমানো হয়েছে। ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনের (আইওসি) তথ্য মতে, দিল্লিতে প্রতি লিটার পেট্রোল ৫৯ দশমিক ৩ রুপি এবং ডিজেল ৫৯ দশমিক ৩৫ রুপিতে কেনা যাবে। গত ডিসেম্বর থেকে এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো ভারতে জ্বালানির দাম কমানো হয়। ভারত ছাড়াও বিভিন্ন দেশে তেলের দাম কমানো হয়েছে।
গ্লোবাল পেট্রোল প্রাইসেস ডট কমের হিসাব অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বেশি দাম বাংলাদেশে। সবচে কম দাম মালদ্বীপে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও তেলের দাম কমাতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকও বিশ্ববাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় করতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কথা বলেছে। দেশের অর্থনীতিবিদ, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরাও একই দাবি জানিয়ে আসছেন।
দেশীয় বাজারে জ্বালানি তেলের বর্তমান অবস্থাকে হ-য-ব-র-ল মন্তব্য করে চিঠিতে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ অবস্থা বিশ্লেষণ করা দরকার। এই মহূর্তে ১৪ লাখ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত) আমাদের রিফাইনারিতে ব্যবহার করি। এতে যে বিভিন্ন পেট্রোলজাত পণ্য উৎপাদিত হয়, সেটাও আমাদের চাহিদার অতি সামান্য অংশ পূরণ করে।
আমাদের চাহিদা দুটি পেট্রোলজাত পণ্যের জন্য খুব বেশি। সেগুলো হচ্ছে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল। আমরা সম্ভবত বছরে এক কোটি টন পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য ব্যবহার করি এবং তার সিংহভাগ আমদানি করি; যা বিভিন্ন সরকারি কোম্পানির মাধ্যমে বিতরণ করি।
তিনি বলেন, আগে সমুদয় ক্রুড অয়েল এবং পণ্যাদি একমাত্র সরকারই আমদানি করত। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ব্যক্তিমালিকানা খাতের প্রতিষ্ঠানও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য আমদানি করে। বিপিসি আমদানি করা পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যাদির দাম ৩০ ডলারে হিসাব করে। আমরা হিসাব করতাম ৮০ ডলারে এবং সম্ভবত ১১০ ডলারেও হিসাব করেছি।(ইত্তেফাক)
নিউজ ডেস্ক ।।আপডেট : ৩:১০ পিএম, ২১জানুয়ারি ২০১৬, বুধবার
ডিএইচ