Home / সারাদেশ / দেশের ৫ লাখ তরুণী মাদকাসক্ত
দেশের ৫ লাখ তরুণী মাদকাসক্ত

দেশের ৫ লাখ তরুণী মাদকাসক্ত

ইয়াবার প্রতিই আকর্ষণ বেশি
মাদকাসক্তের ৫ ভাগের এক ভাগই নারী
সরবরাহকারীরা পর্দার অন্তরালে


রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ইংরেজী মাধ্যমের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ও’ লেভেলের ছাত্রী। আঠারোর আশপাশে বয়স। তবে এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ।

ক্লাসে অনিয়মিত, পড়ায় মন নেই। নাওয়া-খাওয়া, ঘুমের ঠিক নেই। দুইবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে খুঁজে বের করা হয়েছে। একবার তো প্রায় মরতেই বসেছিল। ফ্যানের সঙ্গে ওড়না জড়িয়ে ফাঁস নেয়ার চেষ্টা করেছিল। অথচ বলতে গেলে কোন না পাওয়ার কষ্টই নেই তার। বাবা ব্যবসায়ী, মা ব্যাংকার। পরিবারের একমাত্র সন্তান। তবু তার ছোট্ট জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে সর্বনাশা মাদকের ছোবলে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে। মেয়েটির মা জানান, আমার মেয়েটাকে কিভাবে যে ভাল করব বুঝতে পারছি না। গাঁজা-ইয়াবা খায় জানতাম। সম্মানের ভয়ে এক বছর কাউকে জানাইনি। নিজেরা চেষ্টা করেছি, ফেরাতে পারিনি। পরে গুলশানের এক নিরাময় কেন্দ্রে দুই মাস রাখলাম। লাখ লাখ টাকা গেল, কিছুই হলো না।

শুধু এ পরিবার নয়, মাদকের থাবায় বিপর্যস্ত সন্তানের কারণে রাজধানীর অনেক পরিবারই এখন দিশেহারা। আর সেই সন্তান যদি হয় মেয়ে তবে যন্ত্রণাও দ্বিগুণ। সামাজিক মর্যাদা, যথাযথ চিকিৎসার ঘাটতিসহ নানা কারণে অভিভাবকদের বিড়ম্বনার অন্ত থাকে না।

বর্তমান সমাজে মাদকের নির্মমতার কাছে সবকিছুই তুচ্ছ হয়ে গেছে। তরুণ-তরুণীরা তিলেতিলে নিজেদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লক্ষাধিক। এদের মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। পুরুষদের বিষয়টি সামনে এলেও নারীরা অন্তরালে থেকে নিজেদের বিলীন করে দিচ্ছে।

মাদক ধ্বংস করে দিচ্ছে ফুলের মতো কতগুলো মানুষের জীবন। যারা এ মাদক সেবন করে তারা তাদের জীবনের প্রতি জুলুমই করে না বরং সমাজের অভিশাপও বটে! যারা মাদকপাচার ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা শুধুই নিজেদের বিবেকের বিসর্জন নয় বরং গোটা জাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের সন্তানরা বিভিন্ন দিক থেকে জড়িয়ে পড়ছে নেশার জগতে। তারা এ বিষয়টি শখের বসে নিতে গিয়ে পরে মাদকাসক্ততে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। আগে দেখা যেত পুরুষদের মাদক সেবনের প্রতি ঝোঁক বেশি। কিন্তু বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বিপজ্জনক হারে এ জগতে প্রবেশ করছে। দিন দিন এর পরিমাণ বেড়েই চলছে। বর্তমানে নারীরা মরণনেশা ইয়াবা বড়ির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে বেশি। মাদকের সহজলভ্যতার ও ব্যাপক প্রসারতার কারণে আসক্ত নারীদের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে পাগলা ঘোড়ার মতো বাড়ছে ইয়াবা বড়ির চোরাচালান। সীমান্ত হয়ে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই ঢুকছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা। কিন্তু ধরা পড়ছে যতসামান্য। অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্য, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় শহর কী গ্রামাঞ্চল; এখন হাত বাড়ালেই মিলছে ঘাতক এই বড়ি। যে কারণে ইয়াবাসেবীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।

কয়েক বছরে মরণনেশা ইয়াবা বড়ির ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে বাংলাদেশে। পুরুষের পাশাপাশি এই মাদক ব্যবসা ও আসক্তিতে বিপজ্জনক হারে বাড়ছে নারীদের সংখ্যা। ফেনসিডিল, হেরোইনসহ অন্যান্য মাদক ব্যবসায় সাধারণত নিম্নআয়ের নারীরা জড়িত। এমনকি ইয়াবা ব্যবসা ও সেবনে শিক্ষিত নারীর সংখ্যাও বাড়ছে। গ্ল্যামার জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত সুন্দরী নারীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া তরুণীরাও জড়িয়ে পড়ছেন ইয়াবা ব্যবসা ও সেবনে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবে, বাংলাদেশে গত সাত বছরে ইয়াবা চোরাচালান বেড়েছে ১৭৭ গুণ (১৭ হাজার ৭২২ শতাংশ)। সেবন অনুযায়ী চোরাচালানের এই সূচক নির্ধারণ করা হয়। আর ইয়াবা উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে পছন্দের শীর্ষে থাকায় ৩২ ধরনের মাদকের মধ্যে ফেনসিডিল, হেরোইন, প্যাথেডিন ও আফিম চোরাচালান আগের চেয়ে অনেকগুণ কমে এসেছে। তবে গাঁজার চোরাচালানের সূচক আগের মতোই ওঠানামা করছে। ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে উদ্ধার হওয়া মাদকদ্রব্যের হিসাবে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যে পরিমাণ ইয়াবা ধরা পড়ে, তার চেয়ে নব্বইগুণ বেশি ইয়াবা এ দেশে সেবন হচ্ছে।

‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ সরকারী বিভিন্ন সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে যে পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে, সে ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৬ সালে ঘাতক এ বড়ি সেবনের সূচক ২০০ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে।

দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশে মরণনেশা ইয়াবা বড়ির ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত ২০১২ সালের এক জরিপে বলা হয়, এ দেশে মাদকাসক্তদের ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ ও ২০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী। অর্থাৎ মোট মাদকাসক্তের পাঁচ ভাগের এক ভাগই নারী। অন্যদিকে জাতিসংঘের এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ৬৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। সেই হিসেবে এ দেশে ১৩ লাখের বেশি নারী কোন না কোন মাদক সেবন করছেন। কিন্তু এসব নারীর ১০ হাজার ভাগের এক ভাগও নিরাময়কেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবা নেন না। কারণ এতে তারা সমাজের কাছে ছোট হয়ে যাবে।

বেসরকারী জরিপের হিসাবে, সারাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৬০ লাখের বেশি। এর মধ্যে নারী মাদকাসক্ত ৫ লাখ। অন্যদিকে মাদকদ্রব নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) জরিপে দেখা যায়, সারাদেশে ৪০ লাখের বেশি মাদকাসক্ত। এতে নারীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া না থাকলেও চার লাখের কাছাকাছি বলে জানা গেছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের জরিপ অনুযায়ী, নারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আসক্ত হয়ে পড়ে।

মাদক বিশেষজ্ঞরা বলেন, নারীরা কৌতুহলের বশে প্রথমে মাদক গ্রহণ করা থেকে তারা আসক্ত হয়ে পরে। এছাড়া পারিবারিক অশান্তি, যে কোন ধরনের হতাশা, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, প্রেমঘটিত ব্যাপার, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, মাদকাসক্ত বন্ধুদের সঙ্গÑ এসব কারণেই আজ নারীরা এই মরণ নেশায় আসক্ত হচ্ছে। মাদকদ্রব্যের ব্যাপক বিস্তারের কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে দেশের যুবসমাজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েরাই বেশি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম জানান, ইয়াবা সেবনের পর প্রথমে মনে হয় শরীরে অনেক শক্তি এসেছে, যৌনশক্তি বেড়ে গেছে, সব ক্লান্তি কেটে গেছে। এটি একটি উত্তেজক মাদক। দীর্ঘমেয়াদে এটি পুরো স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রচ- খারাপ প্রভাব ফেলে। স্নায়ুুতন্ত্রের স্বাভাবিক কাঠামো ও কার্যক্রম নষ্ট করে দেয়। এ ধরনের মাদকের প্রভাবে অনেক সময় মানুষ বদ্ধ পাগলের মতো আচরণ করে (সাইকোসিস সিনড্রম)। সেবনের পরপর অনেক ফুরফুরে লাগলেও এর প্রভাব কমে যাওয়ার পরই শরীরময় নেমে আসে রাজ্যের অবসাদ ও ক্লান্তি। ফলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের (স্ট্রোক) ঝুঁকিও তৈরি হয়। মাদক চিকিৎসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা জানান, এখন মাদকসেবীদের বেশির ভাগই ইয়াবা আসক্ত।

পুরুষরা মাদকাসক্ত হলে তাদের নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। ফিরিয়ে আনা হয় স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু নারী মাদকসেবীরা চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা, সামাজিক মূল্যবোধসহ নানা কারণে পর্দার অন্তরালে থেকে যায়। অনেকে সুস্থ হয়ে উঠতে চাইলেও সমাজে জানাজানি হয়ে যাবে এতে বিয়েশাদিতে পারবর্তীকালে সমস্যা হতে পারে। ক্ষুণœ হতে পারে সামাজিক মর্যাদা এসব কারণে নারীরা লোকলজ্জায় চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে অনীহা জানায়। চিকিৎসা না নেয়ার প্রবণতায় দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। পাশাপাশি নেশার জগত থেকেও ফিরতে পারছেন না। এর প্রভাব পড়ছে পুরো পরিবারে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রতিনিয়তই মিথ্যা কথা বলে তরুণীরা নেশার জগতে বুদ হয়ে থাকে। তারা যে নেশা করে সেই সত্যতা গোপন করার জন্য প্রতিনিয়তই মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে।

এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন) মোঃ আবুল হোসেন বলেন, মাদকাসক্ত নারীকে সমাজ ভিন্ন চোখে দেখে। এই মানসিকতা ও লোকলজ্জায় নারী মাদকাসক্তরা চিকিৎসা সেবা নেন না বললেই চলে। মাদকাসক্ত নারীরা পুরুষের তুলনায় দ্রুত আক্রান্ত হয়। তাদের চিকিৎসা না দিলে ব্যক্তিজীবনেও প্রভাব পড়ে। নারী মাদকাসক্তদের প্রথম পছন্দ ইয়াবা। এরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সহিংস আচরণ দেখায়। আর এসব বিষয় গোপন রাখায় নারীরা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোগে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পারিবারিক সচেতনতা জোরদার করা জরুরী বলে মনে করেন তিনি।