চোখের ব্যথা বাড়তে থাকলে রহিমা বেগম যান বাড়ির পাশে একটি ওষুধের দোকানে। দোকানির পরামর্শে ড্রপ ব্যবহার করতে থাকেন। এক মাস ব্যবহারের পর ঘায়ের মতো দেখা দিলে রহিমা বেগম শরণাপন্ন হন গ্রাম্য চিকিৎসকের।
তার অধীনে চিকিৎসা চলে মাসখানেক। তার পরও রহিমা বেগমের চোখের ব্যথা কমেনি। ওষুধের দোকানি-হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসা শেষ করে গত মাসে তিনি ভর্তি হন ঢাকার একটি চক্ষু হাসপাতালে। ততক্ষণে দৃষ্টিশক্তির অনেকটাই হারিয়ে ফেলেন নোয়াখালীর এ বাসিন্দা।
রহিমা বেগম একা নন, দেশের বেশির ভাগ রোগীই চিকিৎসা নিতে দ্বারস্থ হচ্ছেন অচিকিৎসকদের। কেউ ছুটছেন ওষুধের দোকানে, কেউ আবার হাতুড়ে ডাক্তারের চেম্বারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬-এর তথ্যমতে, এখনো দেশের ৫৫ শতাংশ রোগীই চিকিৎসা নিচ্ছে এসব অচিকিৎসকের কাছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যোগ্য চিকিৎসকের পরিবর্তে অচিকিৎসকদের কাছ থেকে সেবা নেয়ার কারণে ছোটখাটো সমস্যাও পরবর্তীতে জটিল আকার ধারণ করছে। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে শরীর হয়ে পড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ফার্মেসি কিংবা হাতুড়ে ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়ার কারণে মানুষ অনেক সময় ভুল চিকিৎসার শিকার হন। এছাড়া অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করেন না। ফার্মেসির কম্পাউন্ডাররা রোগের একটু প্রশমন হলেই অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দেন। এতে রোগীর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা পরবর্তীতে জটিল রূপ ধারণ করে।
দেশের ২ হাজার ৩০৪টি নমুনা এলাকার ৪৬ হাজার ৮০টি খানার ওপর জরিপ চালিয়ে খানা আয়-ব্যয় জরিপ প্রতিবেদন ২০১৬ তৈরি করেছে বিবিএস। গত বছরের অক্টোবরে জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, চিকিৎসাপ্রার্থীদের বড় অংশই যাচ্ছে ওষুধের দোকানে। ফার্মেসি, ডিসপেনসারি বা কম্পাউন্ডারের কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা নেয় ৩৩ দশমিক ১১ শতাংশ রোগী। এরপরই সবচেয়ে বেশি ২২ দশমিক ৫১ শতাংশ যাচ্ছে হাতুড়ে ডাক্তারের চেম্বারে। যোগ্য চিকিৎসকের কাছ থেকে সেবা নিচ্ছে মাত্র ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ রোগী।
যদিও জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে দেশের প্রতিটি উপজেলায় রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ইউনিয়ন পর্যায়ে আছে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, স্যাটেলাইট ক্লিনিক বা ইপিআই আউটরিচ সেন্টার। এছাড়া সরকারের স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থা দেশব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা চালু রেখেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাসেবা নেয়া রোগীর হার প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম।
বিবিএসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে ১ দশমিক ৪৪, সরকারি স্যাটেলাইট ক্লিনিকে শূন্য দশমিক ১৯, কমিউনিটি ক্লিনিকে ১ দশমিক ৭, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শূন্য দশমিক ৩৩ ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫ দশমিক ২২ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নেয়।
শুরুতে সঠিক জায়গায় সঠিক চিকিৎসা না হওয়ার কারণে সাধারণ রোগ জটিল আকার ধারণ করছে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, মেডিকেল শিক্ষার অভাবের কারণে মানুষ ওষুধের দোকানদার কিংবা কোয়াকের (হাতুড়ে চিকিৎসক) কাছে যায়, আর ভুল চিকিৎসার শিকার হয়।
রক্তনালির টিউমারে আক্রান্ত মুক্তামনির উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, মুক্তামনিই যদি গ্রাম্য চিকিৎসক বা কবিরাজের কাছে চিকিৎসা না নিয়ে শুরুতে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেত, তাহলে আজ সে সুস্থ থাকত। আমরা প্রায়ই দেখি, রোগীরা একেকটা সাধারণ ঘা জটিল আকার ধারণ করলে হাসপাতালে আসছে।
তিনি আরো বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় সপ্তাহে একদিন সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সম্পর্কে বোঝাতে হবে। ছোট একটি টিউমার হলেও এমবিবিএস চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার বিষয়ে বোঝাতে হবে। মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে নজরদারি বাড়াতে হবে, যাতে যে কেউ ডাক্তারি প্র্যাকটিস করতে না পারে। এছাড়া ওষুধ প্রশাসনের নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। যাতে কেউ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কিনতে না পারে।
শহর ও গ্রামভেদে হাতুড়ে ডাক্তার ও ওষুধের দোকানে চিকিৎসা নেয়ার হারে পার্থক্য রয়েছে। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, গ্রামে ফার্মেসি, ডিসপেনসারি বা কম্পাউন্ডারের কাছ থেকে সেবা নেয়ার হার ৩২ দশমিক ৭৯ শতাংশ হলেও শহরে এ হার ৩৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অন্যদিকে গ্রামের ২৫ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ রোগী যাচ্ছে হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে। তবে শহরে যাচ্ছে তুলনামূলক কম, ১৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।
অচিকিৎসকদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার এ সুযোগ বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, যোগ্যতা ছাড়াই স্বাস্থ্যসেবা দেয়া বড় ধরনের অন্যায়। এটা বন্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাগ্রহীতা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সুরক্ষা আইন তোলা হবে। আইন দুটি পাস হলে যেসব ডিসপেনসারি ওষুধ বিক্রির পাশাপাশি চিকিৎসাসেবা দেয়, সেগুলোর বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পদক্ষেপ নিতে পারবে। একই পদক্ষেপ নেয়া যাবে নন-কোয়ালিফায়েড চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও।