সারাদেশ

দেশের ৩৩ ভাগ গর্ভধারণ অপরিকল্পিত

দেশের ৩৩ % গর্ভধারণ অপরিকল্পিত। ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভধারণের কারণে অনেকে গর্ভপাত ঘটান। অধিকাংশ সময় সে গর্ভপাত হয় অনিরাপদ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে ১৪% মাতৃমৃত্যুর কারণ অনিরাপদ গর্ভপাত। অপরিকল্পিত এ গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের পুরো ঝুঁকি পোহাতে হয় নারীকে। আর দেশে প্রসব পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের হারও সন্তোষজনক নয়।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর পরিকল্পিত পরিবার গঠনের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন, প্রজনন স্বাস্থ্য, নিরাপদ মাতৃত্ব, জেন্ডার বিষয়ক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে বিগত ছয় দশক ধরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

মা ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও অপরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভপাত সমস্যা কমছে না। এর পাশাপাশি বর্তমান তরুণ-তরুণীরা গোপন মিলনে জড়িয়ে পড়ছে এবং এতে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের ঘটনাও বেড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ না করাকে অনেকে মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অল্প বয়সে বিয়ে হলেও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করলে ৩২ % বেশি মাতৃমৃত্যু রোধ করা সম্ভব। নিরাপদ মাতৃত্ব নিয়ে কাজ করে ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড পেরেন্টহুড ফেডারেশন। এ আন্তর্জাতিক এনজিওটির কাগজপত্র বলছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪০ লাখ নারী গর্ভধারণ করেন।

তাঁদের মধ্যে ১৩ লাখই থাকেন অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ। পরিবার-পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সঠিক ব্যবহার না জানা, পদ্ধতির স্বল্পতাই অপরিকল্পিত গর্ভধারণের মূল কারণ।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির অধিকাংশই নারীর ব্যবহারের জন্য। স্থায়ী পদ্ধতি ছাড়া পুরুষের ব্যবহারের জন্য কনডমই একমাত্র পদ্ধতি। পরিবার-পরিকল্পনাকর্মীরা বলছেন, নারীর তুলনায় কমসংখ্যক পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

এনজিও মেরী স্টোপস প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা দেয়। এনজিওটির পরিচালক কাজী গোলাম রসুল বলেন, অনিরাপদ গর্ভপাতের পর ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, জরায়ু, মূত্রনালি এবং অন্ত্রনালি ছিদ্র হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তা ছিঁড়ে এক হয়ে যাওয়া, বন্ধ্যত্বের শিকার হওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হন নারীরা।

বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিভেনশন অব সেপটিক এবরশনের পরিচালক আলতাফ হোসেন বলেন, অনাকাক্সিক্ষত সন্তান না রাখতে চাইলে তার পথও খোলা আছে। নারীর শেষ মাসিকের প্রথম দিন হিসাবে ৬ থেকে ১০ সপ্তাহের মধ্যে এমআর বা মাসিক নিয়মিত করার পদ্ধতি বৈধ।

তিনি বলেন, অনেক স্বামী নিজে সচেতন না হয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা হিসেবে এমআরকেই বেছে নেন। এটা যে স্ত্রীর শারীরিক ক্ষতির কারণ,তা আমলে নেন না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নার্গিস আকতার বলেন, শারীরিক কারণে অনেক নারী স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন না। তাদের স্বামীরাও কোন পদ্ধতি গ্রহণ করেন না। তাই কোনো কোনো নারীকে দু-তিনবার পর্যন্ত এমআর করে দিতে হচ্ছে।

রিপ্রোডাকটিভ হেলথ সার্ভিসেস ট্রেনিং এ্যান্ড এডুকেশন প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক কাজী সুরাইয়া সুলতানা বলেন, দেশে বহুবিবাহের প্রবণতা বেশি। এছাড়া অনৈতিক সম্পর্ক করারও ঝুঁকি আছে। তাই একজন পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করলে অনেক ক্ষেত্রে একাধিক নারী অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণের হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণের কুফল সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রচার বাড়ানো জরুরী। পাশাপাশি পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য পরিবার-পরিকল্পনা কর্মসূচীতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার বলে অনেকে মনে করেন।

প্রসব পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ রোধ করার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বলেন, গত দশ বছরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারকারীর হার বৃদ্ধি হলেও স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতিতে তেমন কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ ছোট পরিবার গঠনের অন্যতম পূর্বশর্ত।

দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের হার বৃদ্ধির জন্য সক্ষম দম্পতি তথা জনগণকে বিভিন্ন তথ্য ও সেবা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে প্রসব পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ উল্লেখযোগ্য।

এ বিশেষ সপ্তাহে পরিবার পরিকল্পনা স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহীতার সংখ্যা প্রায় ৩০ % বৃদ্ধি পায়। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির গ্রহীতা বৃদ্ধি মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসে সরাসরি প্রভাব রাখতে সক্ষম বলে মনে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩১ লাখ প্রসব সংগঠিত হয় । যার প্রায় ৩৭.৪ শতাংশ (১১ লাখ) প্রসব হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের পরপরই মা’কে যদি প্রসব পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনার আওতায় আনা যায় তাহলে একদিকে যেমন অনিচ্ছাকৃত ও পুনরায় গর্ভধারণ এড়ানো সম্ভব তেমনি দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী পদ্ধতি বিশেষ করে টিউবেকটমি ও আইইউডি গ্রহীতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা সম্ভব।

সক্ষম দম্পতিদের ক্ষেত্রে দু’সন্তানের মাঝে ন্যূনতম (৩ বছর) বিরতি এবং দুটি জীবিত সন্তানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টির বয়স কমপক্ষে ১ বছর হলে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করাই এবারের সেবা ও প্রচার সপ্তাহের মূল লক্ষ্য।

পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির গ্রহীতা বৃদ্ধি মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসে সরাসরি প্রভাব রাখতে সক্ষম। সরকারের এ প্রচেষ্টার পাশাপাশি গণমাধ্যমের সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। প্রসবের পর প্রথম ১২ মাসের মধ্যে অনিচ্ছাকৃত ও স্বল্প বিরতিতে পুনরায় গর্ভধারণ হতে বিরত থাকাই হলো প্রসব পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা।

এর কৌশলগত দিক হলো- প্রসবের পর উপযুক্ত পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ অথবা দুটি সন্তান জন্মদানের মধ্যবর্তী সময়ে একজন নারীর ইচ্ছানুযায়ী প্রয়োজনীয় বিরতি প্রদান (কমপক্ষে ৩ বছর) অথবা সন্তান জন্মদানে সীমিতকরণ। এতে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি-২০১২ এবং এইচপিএনএসডিপি-এর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সিপিআর ৭২ শতাংশে উন্নীত এবং টিএফআর ২.১ অর্জন করার পথ সহজতর হবে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো. নূর হোসেন তালুকদার বলেন, গর্ভকালীন সেবা গ্রহণের হার ২০১১ সালের তুলনায় ৪৩ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮ শতাংশ হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানিক ও দক্ষ সেবাদানকর্মী দ্বারা প্রসবের হার বেড়ে প্রায় ৩৭ শতাংশ হয়েছে। শিশু মৃত্যু হ্রাসেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে। প্রতি ১ হাজার জীবিত জন্মে নবজাতকের মৃত্যুর হার ৩২ থেকে ২৮, এক বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যু হার ৪৩ থেকে ৩৮ এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যু হার ৫৩ থেকে ৪৬ এ হ্রাস পেয়েছে।

অপূর্ণ চাহিদা হ্রাস পেয়ে ১৪ থেকে ১২তে এসেছে। আর ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েদের ক্ষেত্রে সন্তান গ্রহণ প্রবণতা অর্থাৎ কিশোরী বয়সে মাতৃত্বও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এ সকল পরিমাপকে ধনাত্মক পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো সময়ের সঙ্গে মা ও শিশু স্বাস্থ্যে নতুন নতুন কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ।

নিউজ ডেস্ক
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৫ : ০৫ পিএম, ৮ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার
এজি

Share