‘আমি আত্মতৃপ্তি নিয়ে বিচারঙ্গণ থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি আমার সুদীর্ঘ বিচারক জীবনে কখনই জেনেবুঝে বা অবহেলা করে বা অমনযোগী হয়ে কোন ভুল বিচার বা অন্যায় বিচার করিনি।’
প্রায় ৪২ বছরের বিচারক জীবনের শেষ কর্মদিবসে এসে সংবর্ধনায় বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের বিচারপতি ও বাংলাদেশের প্রথম নারী বিচারক নাজমুন আরা সুলতানা এসব কথা বলেন।
আজ দুপুরে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চে এই নারী বিচারপতিকে বিদায় সংবর্ধনা দেন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন।
অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের পক্ষ থেকে এই নারী বিচারপতির বর্ণাঢ্য কর্মজীবন নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরপরে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সভাপতি জয়নুল আবেদীনও বিচারপতির বর্ণাঢ্য কর্মময়জীবন নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন।
এই দু’পক্ষের বক্তব্য শেষে বিচারপতি নাজমুন আরা নিজে তার ৪২ বছরের বিচারিক জীবনের নানা স্মৃতি-অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘প্রায় ৪২ বছরের বিচারকের জীবন আমার শেষ হল আজ। বিচার করার কঠিক কাজ ও বিচারকের সীমাবদ্ধ জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার আগ্রহ ছিলো আমার। আজকের এ ক্ষণটিতে আমার কষ্ট হচ্ছে এই বিচার অঙ্গণ থেকে বিদায় নিতে আপনাদের ছেড়ে যেতে।’
‘আল্লাহ আমাকে বিচারক বানিয়েছেন, এদেশের প্রথম নারী বিচারক। তবে আমার বিচারক হওয়ার পেছনে আমার মরহুম আব্বার ইচ্ছা ও আম্মার প্রেরণা বড় ভূমিকা রেখেছে।’
১৯৭২ সালের আইনজীবী পেশার প্রথমদিন কোর্টের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘বোধহয় আমার মনের কোনায় ইচ্ছাটা উঁকি দিয়েছিলো-আমি কি জজ হতে পারি না? কিন্তু জানলাম আমি জজ হতে পারিনা। ওই সময় বাংলাদেশের নারীরা জজ হতে পারতো না। আমি ওকালতি করার বছর দেড়েক পরে ওই বিধান সরকার তুলে দেয়।’
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন,‘১৯৭৫ সনের শেষের দিকে দেশের প্রথম নারী বিচারক হয়ে খুলনার জজশীপে মুন্সেফ হিসেবে যোগদান করি। ওই সময়ে খবরের কাগজে এটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিলো। প্রতিক্রিয়া দুরকমেরই হয়েছিলো। কেউ স্বাগত আবার অনেকে নাক সিঁটকেছিলেন-নারী আবার বিচারক হতে পারে নাকি-নারী আবার কি বিচার করবে? কর্মক্ষেত্রে আমি এই দুরকমের আচরণ পেয়েছিলাম।’
‘প্রথম নারী বিচারক হিসাবে ব্যর্থ হয়ে যাইনি। আল্লাহর কাছে তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। প্রথম নারী বিচারক হিসেবে আমি ব্যর্থ হলে হয়তো আজ বাংলাদেশের প্রায় ৪০০ নারী বিচারক হতো না।’
নিজের বিচারকাজ নিয়ে প্রথম নারী বিচারপতি বলেন, ‘আমি আত্মতৃপ্তি নিয়ে বিচারঙ্গণ থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি আমার সুদীর্ঘ বিচারক জীবনে কখনই জেনেবুঝে বা অবহেলা করে বা অমনযোগী হয়ে কোন ভুল বিচার বা অন্যায় বিচার করিনি। আমার অনেক বিচারই হয়তো ভুল হয়ে গেছে, আপিলে গিয়ে হয়তো সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু সে ভুল বিচার আমি জেনে বুঝে বা অমনোযোগী হয়ে করিনি। জেনে বুঝে অবিচার করা বা অমনোযোগী হয়ে বা অবহেলা করে ভুল বিচার করা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। পক্ষাশ্রিত হয়ে বা কোন কারণে বা কারো দ্বারা প্রভাবান্নিত হয়ে বিচার করা মহাপাপ। আমার আত্মতৃপ্তি আমি জেনে বুঝে বা অবহেলা করে বা অমনোযোগী হয়ে বা পক্ষাশ্রিত বা প্রভাবিান্নিত হয়ে ভুল বিচার, অন্যায় বিচার করিনি কখনোই।’
১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর বিচার বিভাগে যোগদান করা এ বিচারপতির শেষ কর্মদিবস আগামী ০৬ জুলাই বৃহস্পতিবার। যদিও সুপ্রিম কোর্টের পঞ্জিকা অনুসারে তার অবসরের মেয়াদ ০৭ জুলাই।ওই দিন শুক্রবার হওয়ায় আগেরদিন বৃহস্পতিবারই তার শেষ কর্মদিবস।
প্রথা অনুসারে ওইদিন তাকে সংবর্ধনা দেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের পক্ষ থেকে। বিকালে জাজেস লাউঞ্জে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ তাকে সংবর্ধনা দিবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সান্ড্রা ডে ও’কন্নোর, ব্রিটেনের লেডি ডেম ব্রেন্ডা হেল, ভারতের ফাতিমা বিবির পরে তিনি হচ্ছেন সর্বোচ্চ আদালতের চতুর্থ নারী বিচারপতি।
১৯৫০ সালের ৮ জুলাই মৌলভীবাজারের চৌধুরী জন্ম গ্রহণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। বাবা আবুল কাশেম মঈনুদ্দীন ও বেগম রশীদা সুলতানা দীনের এ সন্তান ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৭ সালে মুমিনুন্নেসা উইমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি এবং আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।
পরবর্তীতে বিচারপতি সুলতানা ১৯৭২ সালে এলএলবি পাস করেন। একই বছর তিনি ময়মনসিংহ জেলা আদালতের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন । কিন্তু সেখানে থেমে থাকেননি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মুনসেফ (সহকারী জজ) হন।
হয়ে যান ইতিহাসের অংশ। দেশ ও বিচার বিভাগের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী বিচারক।
পরবর্তীতে যোগ্যতাই তাকে ১৯৯১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা জজের আসনে উন্নীত করে। আর এটাও প্রথম কোনো নারীর জেলা জজ হওয়ার ঘটনা। তবে নিম্ন আদালতেই থেমে থাকেননি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার কর্মজীবন।
২০০০ সালের ২৮ মে তিনি হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এর দুই বছর পর হাইকোর্টে স্থায়ী হন তিনি।
হাইকোর্টেও তিনি প্রথম। সবশেষ ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি আপিল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ০১ এপ্রিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চের নেতৃত্বে বসান বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে।
বিচারিক কাজের পাশাপাশি বিচারপতি নাজমুন আরা সুলাতানা প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশ ওমেন জাজেস এসোসিয়েশনের। দুই বার সেক্রেটারী ছিলেন ইন্টারন্যাশ অ্যাসোসিয়েশন অব ওমেন জাজেসের। বিশ্বের ৮২টি দেশে যে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫ হাজারের মতো।
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৩: ০০ পিএম, ৬ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার
ডিএইচ