চাঁদপুর

দেশের থাই-পাঙ্গাশ রফতানির উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার : ড. আশ্রাফ

চাঁদপুর নদী গবেষণা কেন্দ্রর ঊধ্বর্তন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.আশ্রাফুল আলম বলেছেন,‘দেশে উৎপাদিত থাই-পাঙ্গাশ বিদেশে রফতানির উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। চাঁদপুরের বিভিন্ন হাট-বাজারে বিলুপ্তপ্রায় বা দেশীয় মাছের সমারোহ বা সয়লাব। ময়মনসিংহ থেকে দিন-রাত শত শত ট্রাক ভর্তি থাই-পাঙ্গশ চাঁদপুরসহ দেশের সব জায়গায়তেই ভোর হলেই আমরা বাজারে দেখতে পাই পাঙ্গাশ। সাধারণ মানুষের চাহিদা বেশি অথচ এর দাম কম।’

তিনি ৩১ ডিসেম্বর দুপুরে তাঁর কার্যলয়ে এ কথাগুলো বলেন।

আমাদের চাঁদপুরসহ দেশের হাওর,নদী, নালা,খাল, বিল,পুকুর ও জলাশয় থেকে নানা পদ্ধতিতে ধরা এসব মাছ এখন বাজার সয়লাব এখন। বিভিন্ন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে বিলুপ্ত প্রায় দেশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। দামেও অনেকটা সাশ্রয়ী। দেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে খাল-বিল-নদীতে এ মাছগুলো এখন পাওয়া যাচ্ছে। একসময় এ গুলো পাওয়া ইহা পাওয়ার দু:সাধ্য হয়ে উঠলেও এখন ঐ দু:সময়টা কেটে যাচ্ছে।

চাঁদপুরের হাট-বাজার ঘুরে দেখা গেছে- দেশি প্রজাতির শোল বোয়াল, শিং, মাগুর, কৈ, টাকি, আইড়, পুঁটি, ট্যাংরা, মেনিসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ চাঁদপুরের বিভিন্ন হাট- বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে।

সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে দেশের নদী. খাল বিলে পুকুরে দেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এসব মাছই বাজারে আসছে। শুধু বাজারই নয়, বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ফেরি করেও একশ্রেণির মাছ বিক্রেতা দেশি প্রজাতির মাছ ভ্যানে করে ছোট ছোট ব্যাটারী চালিত মাইকে সকর প্রকার নারী-পুরুষগণ বর্তমান উৎপাদিত শাক-সবজির সাথে খাপ-খাইয়ে কিনে নিচ্ছে।বিশেষ করে প্রবাসীদের স্ত্রীদের জন্যে এটি একটি সুযোগ সৃষ্টি হওয়্।া আবার কৃষাণ-কৃষাণীগণ দু-জনই যুক্তি করে এসব মাছ কেনার সুয়োগ পাচ্ছে।

ফলে তাদের সময় ও টাকাও সাশ্রয় হয়ে থাক্।ে এমনও দেখা গেছে –সকাল-বিকেল স্বামীগণ দেশের যে কোনো স্থানেই থাকুক না কেন নগদ বা বিকাশের মাধ্যমে টাকা ওেপ্ররন করার পর পরই তারা দৈনন্দিন চাহিদামত মাছ ,তরিতরকারি ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিচ্ছে ।

ময়মনসিংহের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা দেশে বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য প্রজাতির ওপর গবেষণা করে এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এ সব প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে ব্যবহার করে এবং নদ-নদী ও বিলে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বাড়ানোসহ জীববৈচিত্র্য ফিরে আনা হচ্ছে।

এর ফলে এখন এ মাছগুলো অনেক পাওয়া যাচ্ছে এবং এর দামও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে। ওই মাছগুলো হলো – পাবদা, গুলশা, টেংরা, শিং, মাগুর, গুঁজি আইড়, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালী, রাজপুঁটি, মেনি, বালাচাটা, গুতুম, ভাগনা, খলিশা, বাটা, দেশি সরপুঁটি, কালিবাউশ, কই, গজার গনিয়া, বোয়াল,মাগুর, শোল,টাকি ইত্যাদি।

একটি বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ। মাছগুলোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ। এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং রক্তশূন্যতা, গলগন্ড, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এক সময় বাংলাদেশের গ্রামের হাট-বাজার ছিল দেশি মাছের রমরমা সরবরাহ। এখন সেখানে পাওয়া যাচ্ছে চাষের রুই-কাতলা, পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী জানা গেছে- বাংলাদেশে মিঠা পানির ২৬০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪ টি বিলুপ্তপ্রায়। বিগত কয়েক দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি,জলাশয় সংকোচন, অপরিমিত পানি ব্যবহার,কৃষিকাজে কীটনাশকের যথেচ্ছা ব্যবহার, পানিদূষণ এবং অতি আহরণের ফলে বা পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ অনেক কমে যাচ্ছিল ।

প্রাকৃতিক জলাশয়ের অনেক ছোট প্রজাতির মাছ যেমন মলা,ঢেলা, পুঁটি,কাচকি,বাইন,চান্দা ইত্যাদি আবহমানকাল থেকেই গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের পুষ্টির জোগান দিয়ে আসছিল।

বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মিঠা পানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ। দেশে মাছ উৎপাদনে ছোট মাছের অবদান ৩০ থেকে ৩৫ %। দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদনে বর্তমানে চার শতাধিক খামার কাজ করছে। শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলে বছরে ২০০ কোটি পাবদা ও গুলশা ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদিত হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে পাবদা,গুলশা, শিং,টেংরা, মাগুর ও কই ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। ইদানীং বাঢা মাছের চাষও বেড়েছে।

দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার ও মাছের উৎপাদন বাড়ানোর উপযোগী পরিবেশ থাকায় এক সময় দেশি কৈ,শিং,মাগুর,শোল, টাকি,রয়না,সরপুঁটি এবং টেংরা ও বাইনসহ আরও অনেক ধরনের মাছে ভরপুর ছিল। কিন্তু খাল বিল, নদী নালা ভরাট,বেশি হারে মাছ ও শামুক ধরা,কীটনাশক ব্যবহার,অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশীয় মাছ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপও বাড়ছে ।

সম্প্রতি একনেকের অনুমোদন পাওয়া দেশীয় প্রজাতির মাছ এবং শামুক সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের মাছের উৎপাদন ৪ লাখ ৮৪ হাজার মে. টনে উন্নীত হয়েছে বলে জানা গেছে ।

দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার ও মাছের উৎপাদন বাড়ানোর উপযোগী পরিবেশ থাকায় এক সময় দেশি কৈ, শিং, মাগুর, শোল, টাকি, রয়না, সরপুঁটি এবং টেংরা ও বাইনসহ আরও অনেক ধরনের মাছে ভরপুর ছিল। কিন্তু খাল বিল, নদী নালা ভরাট, বেশি হারে মাছ ও শামুক ধরা, কীটনাশক ব্যবহার, অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশীয় মাছ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। অথচ জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপও বাড়ছে ।

এ ব্যাপরে চাঁদপুর নদী গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.মো.আশ্রাফুল আলম বলেন,‘ আমাদের দেশ এখন মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ । দেশের মানুষের সকল আমিষের ৬০ শত্যাংশই মৎস্য খাত থেকে আসা। তাই দেশের মৎস্য বিভাগ দেশের বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বাড়াতে আরো কাজ করছে।’ চাঁদপুরের বিভিন্ন হাট-বাজারে এখন দেশীয় মাছে সয়লাব । মৎস্য চাষ ও ব্যবসায় নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের উৎপাদিত থাই পাঙ্গাশ সরকার বিদেশে রফতানির উদ্যোগ নিচ্ছে ।

তিনি আরও বলেন, ‘ ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার মে.টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। চট্রগ্রামের হালদা নদীটিতে দেশের সকল প্রকার জলাশয়ের মাছের প্রজনন বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নিয়েছে । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ডিসেম্বর মাসে দেশের সবচাইতে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন ক্ষেত্র ‘ হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু হ্যারিটেজ ’ হিসেবে ঘোষণা করেন। সেখানে মাছের প্রজনন বাড়াতে দ্রæত গবেষণা কাজও চলছে। ময়মনসিংহসহ দেশের কয়েকটি মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র দেশের বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বাড়াতে গবেষণা করে যাচ্ছে ।

ঊর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো.আশ্রাফুল আলম বলেন ,‘চাঁদপুর নদী গবেষণা কেন্দ্রটি এখন ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি , হালদায় প্রজনন, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ দূষণরোধ ও জলবায়ূ পরিবর্তনে মৎস্য সেক্টরে করণীয় নিয়ে মৎস্য গবেষকগণ দিনের পর দিন কাজ করছে। মৎস্য সেক্টর এখন অনেক সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছ্।ে চাঁদপুরে ইকো ফিসের সংস্থাও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে।’

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো মৎস্য চাষী মাছের ফেøস সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বা পরিবেশগত কারণে কিংবা কোন ফিসের কোন খাবার দেয়া প্রয়োজন তা তারা জানেন না বলে বর্তমানে পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়ার স্বাদ কিছুটা নষ্ট হচ্ছে । বিশ্ব ওযাল্ড ফিস সংস্থার মতে,আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিদিন গড়ে ৬০ গ্রাম আমিষের প্রয়োজন্। আমরা এখন আমিষ গ্রহণ করছি ৬২ গ্রাম । এসবই দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের খাত থেকে এ আমিষ উৎপাদন হচ্ছে ।’

আবদুল গনি, ১ জানুয়ারি ২০২১

Share