নারী

দেশের ক্রীড়া জগতে আলোচিত ৫ নারীর সফলতার গল্প

৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। পুরুষদের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা সমাজ-সভ্যতার অগ্রযাত্রার ইতিহাসে সমান্তরাল। সমাজের বিভিন্ন স্তরে সাফল্য পাওয়া নারীদের সংখ্যা দিন দিন আমাদের দেশে বাড়ছে। একজন নারী পিছিয়ে থাকা অন্য নারীকে পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সমাজের অন্য সব ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনের নারীরাও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন।

নারী দিবসে সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের মহিলা ক্রিকেটের পেস বোলার জাহানারা আলম, টেনিস-কন্যা আফরানা ইসলাম প্রীতি, হ্যান্ডবলের হাবিবা রূপা, এসএ গেমসে দুই স্বর্ণ জিতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাতারু মাহফুজা খাতুন শিলা এবং একমাত্র মহিলা ফুটবলার হিসেবে দেশের বাইরে লিগ খেলা সাবিনা খাতুন। পরিবারের মানসিকতা ও পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্রীড়া ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন ক্রীড়া অঙ্গনের নারী তারকারা।

ক্রীড়াঙ্গনে নারীরা নিশ্চিত পেশা হিসেবে ক্রিকেটকে নিশ্চিন্তে বেছে নিতে পারে উল্লেখ করলেন সাবেক অধিনায়ক, ‘আমি মনে করি ক্রিকেট পেশা হিসেবে এখন অনেক নিরাপদ। দিন দিন আমাদের সুযোগ সুবিধা বাড়ছে। যে কোনও মেয়ে চাইলেই এই পেশায় আসতে পারে।

খুলনা থেকে উঠে আসা জাহানারা পরিবারের কাছ থেকে কোনও বাধা না পেলেও প্রতিবেশীরা নানা কথা বলতো। প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাদের মুখও বন্ধ করেছেন জাহানারা, ‘পরিবার থেকে আমার কোনও সমস্যা ছিল না। এক্ষেত্রে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলতে পারি। এলাকার কিছু লোকের পাশাপাশি দূরের কিছু আত্মীয় স্বজন প্রশ্ন তুলেছিল, মেয়ে হয়ে কেন ক্রিকেট খেলতে হবে? তবে জাতীয় দলে খেলার পর তাদের প্রতিক্রিয়া পাল্টে যায়। তারা এখন বলে খুলনার সুনাম বাড়িয়েছে জাহানারা।’

জাহানারা মনে করেন মেয়েদের আত্মবিশ্বাস সবচেয়ে বেশি জরুরী, ‘আত্মবিশ্বাসী নারীরা এগিয়ে যাবেই। একটি দিনই নারীদের নয়। আমি মনে করি প্রতিটি দিনই নারীদের হোক। তারপরও আন্তর্জাতিকভাবে একটি দিনকে নারীদের করা হয়েছে, আমি এই দিবসে সকল নারীদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আপনারা যেটাই ভালোবাসেন সেই কাজটাই করুন। পেছনে অনেকে অনেক কথা বলবে। তাদের কথায় কোনও গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সফল হলে এমনিতেই তারা আপনার কাছে আসবে।’

পরিবেশ ও মানুষের সংকীর্ণ মানসিকতার কারণে দেশের নারীরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করেন সাবিনা খাতুন। প্রথম বাংলাদেশি মহিলা ফুটবলার হিসেবে দেশের বাইরে লিগ খেলেছেন তিনি। ২০০৯ সালে জাতীয় দলের ক্যাম্পে সুযোগ পাওয়ার আগে জেলা পর্যায়ে খেলেছেন সাতক্ষীরা থেকে উঠে আসা এই ফুটবলার। নিজের কঠিন পরিস্থিতি বলতে গিয়ে সাবিনা বলেছেন, ‘কঠিন পরিস্থিতিটা আমি জয় করে এসেছি। সমর্থন শুরুতে তেমন না পেলেও আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল আমি ফুটবলার হতে পারব। এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলতে পারছি। এটা ভেবে খুব ভালো লাগে।’

সমাজের কে কী বললো সেটায় গুরুত্ব না দিয়ে পরিবারের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানালেন সাবিনা, ‘আমাদের সবার পরিবারকে তাদের মেয়ে সন্তানদের সমর্থন দিতে হবে। বাইরের লোক কে কী বললো, তাতে মাথা না ঘামিয়ে পরিবারের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে পরিবারকে অবশ্যই বুঝতে হবে মেয়ে কী চাইছে। পরিবার পাশে দাঁড়ালে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।’

অনূর্ধ্ব ১৪ টেনিস চ্যাম্পিয়ন হওয়া আফরানা ইসলাম পরিবারের কাছ থেকে যথেষ্ট সমর্থন পাননি। সেই হতাশার কথা প্রীতি বলেছেন এভাবে, ‘আমার বাবা চায়নি মেয়ে হয়ে আমি খেলাধুলায় আসি, অনেক সংগ্রাম করে আমাকে বিকেএসপিতে ভর্তি হতে হয়েছে। বাবা বলতো খেলাধুলা করে কী হবে। কতটুকুই বা করতে পারবে। তবে শুরুতে যে বাবা আমাকে সাপোর্ট করেনি, সেই বাবাই এখন প্রতি মুহূতে আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন।’

টেনিসে নারীদের সফলতা পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়, অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটাই প্রযোজ্য‍। কারণ এখানে টেনিস তেমন একটা জনপ্রিয় খেলাও নয়। তবুও একজন নারী হয়ে এখানে আসার কারণটা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে ৪০-এর বেশি ট্রফি জেতা প্রীতি, ‘টেনিসটা এতটা জনপ্রিয় খেলা নয়, যতটা ক্রিকেট কিংবা ফুটবল। তারপরও আমার কাছে টেনিস জনপ্রিয় খেলা। আমি ছোটবেলা থেকেই এই খেলাকে খুব পছন্দ করি। তবে একদম ছোট বেলাতে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। কিন্তু বিকেএসপিতে এই সাবজেক্ট না থাকায় টেনিসেই ভর্তি হতে হয়েছে। আর নারীদের সংগ্রাম সবখানেই করতে হয়। সংগ্রামে জেতার পর সবাই ঠিকই বাহবা দেবে, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’

স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠিত করতে নারীদের পরিশ্রম করার আহ্বান প্রীতির, ‘মেয়েদের উচিত আত্মনির্ভরশীল হওয়া। স্বপ্নপূরণ করার জন্য একজন মেয়ের যা যা করা উচিত, তা করা। কোনও নারীর মনে সংশয় থাকলে সে পিছিয়ে যাবেই। নারীদের সম্মান দিতে পুরুষদের কাছে আহ্বান জানাব। আশা করি সব নারী নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবে পরিশ্রমের মাধ্যমে।’

বাধা পেরোনের গল্প শুনিয়েছেন হ্যান্ডবল জাতীয় দলের খেলোয়াড় হাবিবা রূপা। খেলোয়াড় হয়ে ওঠার পেছনে পরিবারের অসহযোগিতার কথা ওঠে আসে তার কথাতে, ‘শুরুতে তো অনেক সমস্যা হতো। পরিবার কোনোভাবেই মেনে নেবে না আমি হ্যান্ডবল খেলব। তারপরও নিজে সংগ্রাম করে হ্যান্ডবল খেলোয়াড় হয়েছি। তবে ধীরে ধীরে সাফল্য পাচ্ছিলাম, তখন পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন সাপোর্ট করা শুরু করে।’

নারীদের উদ্দেশে রূপা বলেছেন, ‘বাধাকে বাধা মনে করে থেমে গেলে নিজেদের জায়গা নারীরা করে নিতে পারবে না। যে কোনও কাজে বাধা আসবেই। সেই বাধা নিজের দক্ষতা দিয়ে দূর করতে হবে।’

মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার উপায় হিসেবে ক্রীড়া একটি ভালো উপায় হতে পারে বলে মনে করেন তিনি, ‘মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য খেলাধুলা ভালো একটি উপায় হতে পারে। আমি মনে করি পরিবারের সমর্থন ও নিজের ইচ্ছার মাধ্যমে ভালো খেলোয়াড় হওয়া সম্ভব। স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যমে একজন নারী নিজের পরিচয় সমাজের কাছে তুলে ধরতে পারে।’

গুয়াহাটি এসএ গেমসে দুই স্বর্ণ জয়ী মাহফুজা খাতুন শিলা। নারী দিবস সম্পর্কে মাহফুজা খাতুন শিলা বলেছেন, ‘আমি শুধু ক্রীড়াঙ্গন নয়, সামগ্রিক অর্থেই বলব নারীরা এগিয়ে আসছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সার্ভিসেস বাহিনী- সর্বত্র নারীদের ভূমিকা রয়েছে। একজন নারীকে দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে হয়। পেশাদার দায়িত্বের পাশাপাশি পারিবারিক কাজ।’

বাবা-মা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে নারী খেলোয়াড়রা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন বলে জানান শিলা। কতটা সংগ্রাম করেছেন, সেটা উল্লেখ্য করে শিলা বলেছেন, ‘আমাদের এখানে আসার পথটা অনেক কঠিন ছিল। অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে আমরা খেলাধুলা চালিয়ে গিয়েছি। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনেও নারীরা একটা বাড়তি চাপ নিয়ে আসে। সব নারী সমান সহযোগিতা পায় না পরিবার থেকে। এটা অনেক ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। শুরু থেকে প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আসার পর পরবর্তীতে ক্রীড়াঙ্গনের বাধা খুব বড় কিছু মনে হয় না।’

(বাংলা ট্রিবিউন)

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৭: ৩০ পি.এম ৯মার্চ,২০১৮ শুক্রবার
এএস.

Share