‘মানুষ মরণশীল’ এই সত্যকে ধারণ করে পৃথিবীর নিয়মেই প্রতিটা মানুষকে মৃত্যুর হাত ধরে একদিন অনন্ত জীবনে চলে যেতে হয়। এই যে আমাদের পৃথিবীতে আসা এবং চলে যাওয়া, মাঝের এই সময়টা ব্যাক্তির কর্মকান্ড পৃথিবীতে তাঁকে অনন্ত জীবন দান করে।
ব্যক্তির ভালো কর্মকান্ড তাকে যেমনিভাবে সম্মানিত করে বাঁচিয়ে রাখে ঠিক তেমনিভাবে তার কু’কর্মের জন্যও তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকেন। ক্ষুদ্র এ জীবনে যে ক’জন ব্যক্তি পৃথিবীতে সৎকর্ম রেখে গেছেন তারা যুগযুগান্তর ধরে বেঁচে আছেন এবং অন্তকাল বেঁচে খাকবেন।
এদেরই একজন চাঁদপুরের নারী পুলিশ সুপার পদে জনাব শামসুন্নাহার যোগদান করেন গত ২০১৫ সালের ১২ জুন শুক্রবার।
চলতি বছরের ১২ জুন তাঁর পুলিশ সুপার পদে কর্মজীবনের এক বছর পূর্তি। ছুটির দিনেই তিনি তাঁর পূর্বসূরি জনাব আমির জাফরের কাছ থেকে চাঁদপুরের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
এখানে যোগদানের সাথে সাথে তিনি মাদক, সন্ত্রাস, বাল্য বিয়ে ও নারী-শিশু নির্যাতনের ব্যাপরে জিরো টালারেন্স ঘোষণা করেন এবং অনেকগুলো ইতিবাচক কর্মকান্ডে জনমনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তিনি অনেকটাই প্রমাণ করেছেন পুলিশ জনগণের বন্ধু।
এ জেলার কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম বেগবান করেন এবং বর্তমান আইজিপি একেএম শহীদুল হককে চাঁদপুরে কমিউনিটি পুলিশিং সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে আনতে সক্ষম হন।
পুলিশ সুপার পদে এই জেলার আসার প্রথম বছরই শামসুন্নাহার জাতীয় পুলিশ প্যারেডে প্রথম নারী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সারাদেশে বেশ আলোচিত হন।
বর্তমানে তিনি চাঁদপুর জেলাকে মাদক, সন্ত্রাস, বাল্যবিয়ে ও শিশু নির্যাতনসহ সমাজিক অপরাধমুক্ত করণে দৃশ্যমান জন্যে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন।
ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বুজতে পেরেছেন যে মাদক ভয়াবহ রুপ ধারণ করে বর্তমান সমাজের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পরেছে।
তাই শুধুমাত্র শাস্তি দিয়ে কিছুতেই মাদক সমূলে নির্মূল করা সম্ভব নয়। আর এজন্য তিনি চাঁদপুর জেলাকে মাদকমুক্ত করতে কিছু ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছেন।
মাদক ব্যবাসায়ীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের পরিবারকে সতর্ক করার পাশাপাশি মাদকের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরেছেন।
তিনি সুশিল সমাজের সহযোগিতায় বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে জেলার জনবহুল এলাকা, হাট বাজারগুলোতে মাদকবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন।
পাশাপশি তিনি ‘মাদক বিক্রেতা ও মাদক সেবনকারীদের এ পথ থেকে সরে না আসলে কঠোর সাঁজার আওতায় আনা হবে’ বলে কাছে হুশিয়ার করে দিচ্ছেন।
পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার নির্যাতিত নারী ও শিশুদের কথা চিন্তা করে ২০১৫ সালে ১৫ অক্টোবর নারী পুলিশ সুপার কার্যালয়ে অভিযোগ সেল গঠন করেন। যেখানে প্রতিদিন নির্যাতিত নারী ও শিশুরা সেবা পেয়ে আসছে। এতে করে পুলিশ সুপারের প্রতি নারীদের আস্থা অনেকাংশে বেড়ে গেছে।
এছাড়াও পুলিশ সুপারের কঠোর অবস্থানের ফলে চাঁদপুর জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অন্যান্য জেলার চেয়ে স্বাভাবিক রয়েছে বলে জেলাবাসী বিশ্বাস করে।
এতে করে সম্প্রতি সময়ে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যখন একাধিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে সেখানে চাঁদপুর জেলার চিত্র ছিলো অনেকটাই ভিন্ন।
জেলাবাসীর বিশ্বাস পুলিশ পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার হয়তো একদিন পনোন্নতি পেয়ে আরো উচ্চতায় পৌঁছে যাবেন। হয়তো একটা সময় তিনিও মৃত্যুর হাত ধরে অনন্ত জীবনে পা রাখবেন।
তবে তার সৎ কর্ম এই পৃথিবীতেই তাকে অনন্ত জীবন দান করবে। আর এটাই চাঁদপুরবাসীর প্রত্যাশা।
এক নজরে পুলিশ সুপার শামসুন্নাহারের জীবন বিত্তান্ত………….
চার ভাইবোনের মধ্যে শামসুন্নাহার সবার বড়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও এমফিল সম্পন্ন করার পর স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সেখান থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
তারা ২ বোন ও ২ ভাই। সবার বড় তিনি। মা-বাবার স্বপ্নও তাকে নিয়ে ছিল আকাশ ছোঁয়া। মেজো ভাই ডাক্তার। সেজো ভাই হাইকোর্টের আইনজীবী।
সবার ছোট বোন স্কুলের শিক্ষিকা। দুই সন্তানের জননী এই সফল নারী।
১৯৯১ সালে ভর্তি হন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে।
খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন ব্যারিস্টার হওয়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে চান্স না পেয়ে ভেঙে যায় স্বপ্ন। পরবর্তীতে ভর্তি হন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে।
এক অনুষ্ঠানে শামসুন্নাহার বলেন, ‘প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ লাগতো কাঙ্খিত সাবজেক্টে পড়তে না পেরে। কিন্তু পরবর্তীতে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের ভালবাসায় আর সহপাঠীদের সহযোগিতায় ভালো লাগতে শুরু করে সবকিছু।’
বেগম রোকেয়া হলে থাকাকালীন যোগ দেন বিএনসিসিতে। বিএনসিসি’র বিমান শাখার ক্যাডেট ছিলেন তিনি।
১৯৯৩ সালে বিএনসিসি’র পক্ষ থেকে যশোরে যান। সেখানে বিমানবহিনীর কার্যক্রম দেখে মুগ্ধ হন। সেখানকার পাইলটদের ইউনিফর্ম, নিয়ম-শৃঙ্খলা, জীবন প্রণালি মুগ্ধ করে তাকে। আর তখনই মনে মনে স্বপ্ন দেখতে থাকেন এমন একটা চাকরির যেখানে ইউনিফর্ম পরা যাবে। নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। মূলত ইউনিফর্মটাই আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল কিছুটা হেসে বললেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
আর তাই দেরি না করে তখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন বিসিএস’র। ১৯৯৬ সালে অনার্স পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পরই অংশগ্রহণ করেছিলেন ২০তম বিসিএস পরীক্ষায়। নিষ্ঠা আর কঠোর সাধনায় হয়েছেন সফল। প্রথম পছন্দই ছিল পুলিশ। এখনও বিসিএস’র ফল প্রকাশের দিনটির কথা মনে হলে আনন্দিত হন এই পুলিশ সুপার।
ফল প্রকাশের সময় তিনি ছিলেন ৮ মাসের গর্ভবতী। আর তাই ফল প্রকাশের পর যখন ভবিষ্যতে শক্ত, মজবুত অবস্থানের হাতছানি পান তখনই ভেসে যান আনন্দে। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও এমফিল সম্পন্ন করার পর স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তার ভাইবোনও তার মত স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তারা ২ বোন ও ২ ভাই। সবার বড় তিনি।
মা-বাবার স্বপ্নও তাকে নিয়ে ছিল তাই আকাশ ছোঁয়া। মেজো ভাই ডাক্তার। সেজো ভাই হাইকোট্রের আইনজীবী। সবার ছোট বোন স্কুলের শিক্ষিকা।
সুযোগ পেলেই গানের চর্চা করেন। নজরুলগীতি তার সবচেয়ে পছন্দের। বিটিভি’র তালিকাভুক্ত শিল্পী, এই এসপি অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। মুগ্ধ করেন তার সুরের মায়ায় দর্শকদের।
২০০১ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের পর পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশসহ বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের শাখা অফিস ইতালিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
২০০৯ ও ২০১০ সালে পূর্ব-তিমুরে জাতিসংঘ মিশনের জাতীয় পুলিশের মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মকান্ডে দায়িত্ব পালন করেন।
জাতিসংঘে উচ্চপদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন সাতবার জাতিসংঘ শান্তি পদক।
তাছাড়া পুলিশে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য পেয়েছেন দু’বার আইজি ব্যাজ।
তার অরেকটি বড় পরিচয় পুলিশ সপ্তাহ-২০১৬ এ প্যারেডের নেতৃত্ব দেন তিনি।
পুলিশ সপ্তাহের এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মহানগর পুলিশ, রেঞ্জ পুলিশ, আর্মড পুলিশ, ও র্যাবসহ ১৩ টি দলের সহস্রাধিক সদস্যের প্যারেডে নেতৃত্ব দেন এই গর্বিত নারী পুলিশ।
দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো নারী কর্মকর্তা পুলিশ সপ্তাহের প্যারেডে নেতৃত্ব দেন। আর এর মাধ্যমে তিনি গড়েন এক নতুন ইতিহাস।
পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার বলেন, লোকমুখে শুনতে পেতাম পুলিশের দায়িত্ব শুধু ছেলেরাই পালন করতে পারে। মেয়েদের পক্ষে এই গুরুদায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। কিন্তু কর্মজীবনে প্রবেশের পর দেখেছি এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
এ কাজে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। নেই কোনো অসুবিধা। বরং রয়েছে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করতে পারার এক অপরিসীম পরিতৃপ্তি।
প্যারেডে নেতৃত্ব দেয়ার বিষয়টি নিয়ে শামসুন্নাহার বলেন, প্যারেডে নেতৃত্ব দেয়া আমার স্বপ্ন ছিল। ২০০১ সাল হতে পুলিশ একাডেমি সারদার ক্যাম্প থেকে প্যারেড করছি। প্যারেড একটি দায়িত্বশীল ও সূক্ষ কাজ। এজন্য প্রয়োজন পরিশ্রম ও নিষ্ঠা। একটি বাহিনীর প্যারেড কমান্ডার হওয়া সবার জন্যই গৌরবের। প্যারেডে কমান্ডার হওয়ার গৌরব অর্জন করায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্বে নিয়োজিত এ নারী পুলিশ কর্মকর্তা ২০০৮ সালে পুলিশ সপ্তাহের প্যারেডের উপ-অধিনায়ক ছিলেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকায় সেদিন কমান্ডার হওয়ার সুযোগ ছিল না।
আর তাই অপেক্ষায় ছিলেন এই দিনটির। তার নেতৃত্ব ও দৃঢ় পদক্ষেপ স্বয়ং নজর কাড়ে প্রধানমন্ত্রীর।
প্রতিবেদক- আশিক বিন রহিম
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১০:৩৫ পিএম, ১২ জুন ২০১৬, রোববার
ডিএইচ