ফিচার

দেওয়ান বাগের পীর নিয়ে যা বললেন তসলিমা

বাংলাদেশে দেখতাম চারদিকে পীর, ভারতে দেখি চারদিকে বাবা। প্রায় সবারই কোনও না কোনও পীর বা বাবা আছে। পীর এবং বাবার পায়ে মানুষ কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে আসে।

টাকা আর আনুগত্যের বিনিময়ে পীর এবং বাবা ভগবান এবং আল্লাহর কাছে তদবির করে ইহকাল এবং পরকালের সুখ স্বাস্থ্য, আনন্দ আয়েশ, বিত্ত বৈভবের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন বলে মুরিদ এবং ভক্তকূল বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস বড় ভয়ঙ্কর। এই বিশ্বাসের কারণে মানুষ অনেক সময় সর্বস্বান্ত হয়ে যায়, কিন্তু তারপরও পীর বা বাবার ওপর থেকে মানুষের নির্ভরতা যায় না।

আমার মা ছিলেন নওমহলের এক পীরের মুরিদ। কী করে সেই পীর যে মা’র মগজধোলাই করেছিলেন! সেই পীর যা বলতেন, মা সব বিশ্বাস করতেন। একবার পীর বললেন তিনি মা’কে এবং তাঁর আরও কয়েকজন মুরিদকে উড়িয়ে নিয়ে যাবেন মক্কায়।

হ্যাঁ উড়িয়ে, মা’রা কার্পেটের ওপর বসে থাকবেন, কার্পেটই নিজে নিজে উড়ে যাবে পবিত্র শহরটিতে। মা তো রীতিমত সুটকেস গুছিয়ে রেখেছিলেন। বাস্তববাদী মানুষও কী করে অমন অবাস্তব ব্যাপার বিশ্বাস করতে পারেন আমি জানি না।

শুধু কি উপমহাদেশে? মনে আছে আমেরিকার পীর জিম জোন্সের কথা, ১৯৭৮ সালে গায়ানার জোন্সটাউনে ৯০৯ জন ভক্তকে বললেন বিষ খেতে, সকলে চুপচাপ বিষ খেয়ে মরে গিয়েছিল, শুধু তাই নয়, নিজেদের শিশু সন্তানের মুখেও নিজের হাতে বিষ ঢেলে দিয়েছিল? বিশ্বাস এমনই ভয়ঙ্কর। ১৯৯৭ সালেও ক্যালিফোর্নিয়ায় ৩৯ জন মানুষ তাদের খ্রিস্টান পীরের আদেশে আত্মহত্যা করেছিলো, বিশ্বাস ছিল মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ইউএফওতে চড়ে স্বর্গে যাবে।

বাংলাদেশের দেওয়ানবাগী পীর এখন হাসপাতালে। যে পীর মানুষের রোগ সারানোর জন্য পানি পড়া দিতেন, যেন কাউকে হাসপাতালে না যেতে হয়, সেই তিনিই আজ হাসপাতালে। কেউ কি এখন তাঁকে তাঁর নিজের ‘পানি পড়া’ খেয়ে সুস্থ হওয়ার উপদেশ দিচ্ছে না?

ভারতের সত্য সাঁই বাবা ঘোষণা করেছিলেন, তিনি মারা যাবেন ২০২২ সালে, কিন্তু মারা গেলেন ২০১১ সালে। এতে কিন্তু তাঁর ভক্তসংখ্যা কমেনি। সত্য সাঁই বাবা দু’ আঙুলের ফাঁকে ছাইএর বড়ি লুকিয়ে রেখে জনসমক্ষে হাতে কিছু নেই এমন ভাব দেখাতেন, তারপর কৌশলে আঙুলের ফাঁক থেকে সেই ছাইএর বড়ি বের করে বুড়ো আঙ্গুলের চাপে তা গুঁড়ো করে ‘পবিত্র ছাই’ বা বিভুতি ছিটিয়ে দিতেন অন্ধ ভক্তদের দিকে। ভক্তরা বিশ্বাস করতো তাদের সব দুর্দশা ঘুচে যাবে।

সত্য সাঁই বাবার যাদুগুলো ছিল খুব দুর্বল। মাথায় দু’ছটাক বুদ্ধি থাকলেই ধরতে পারা যায় তিনি তোয়ালের ভেতর সোনার ডিম লুকিয়ে রেখে কাশতেন আর কাশতে কাশতে যেন মুখ থেকে সোনার ডিম বেরিয়েছে এমন অভিনয় করতেন। সত্য সাঁই বাবা সমকামী ছিলেন, সুশ্রী বালকদের প্রচুর যৌন হেনস্থা করেছেন। মানুষ হত্যাও করেছিলেন, তারপরও তাঁর অপরাধের বিচার হয়নি।

এখন ১২৬ টি দেশে তাঁর নামে ১২০০টি সত্য সাঁই কেন্দ্র। শত অপরাধ করেও পীর এবং বাবারা পার পেয়ে যান। কারণ তাঁদের ভক্তকূলের মধ্যে দেশের রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, উকিল, ব্যবসায়ী, বিচারপতি সবাই আছেন।

শচীন টেন্ডুলকার তো সম্ভবত কোটি কোটি টাকা দান করেছেন সত্য সাঁই বাবাকে। মারা যাওয়ার পর কত যে সম্পদ বেরিয়েছে তাঁর প্রাসাদ থেকে। সব ভক্তদের টাকা। বিশ্বাসের টাকা। অন্ধ বিশ্বাসের, বোকামোর। ভক্তদের টাকায় হাসপাতাল বানিয়ে সত্য সাঁই নিজের দুর্নাম চাপা দিয়েছিলেন। লোকে ভাবে হাসপাতাল বানিয়ে ভীষণই মহৎ কাজ করেছেন।

পীর এবং বাবা-ব্যবসা রমরম করে বেড়ে চলেছে। তার মানে প্রতারণা বেড়ে চলেছে। গুজরাটের আসারাম বাপু ধর্ষণের আসামী। খুন, ধর্ষণ, এবং অবৈধভাবে সম্পদ- সম্পত্তি আত্মসাতের দায়ে ভারতের অনেক সাধু সন্ত গুরু বাবাই এখন কারাগারে।

স্বামী নিত্যানন্দ, সন্ত রাম্পাল, চন্দ্রস্বামী, স্বামী সদাচারী, স্বামী প্রেমানন্দ, শ্রীমুরাথ দ্বিভেদি এরকম অনেকেই জেলের ভাত খাচ্ছেন। এত কিছুর পরও কিন্তু বাবা সম্প্রদায়ের বাজার মোটেও মন্দা নয়। ধর্মকে যেমন বাঁচিয়ে রেখেছে ধার্মিকেরা, পীর বাবাদেরও বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁর ভক্ত মুরিদেরা। আর ভক্ত মুরিদদের বাঁচিয়ে রেখেছে দেশ জুড়ে অজ্ঞতা আর অবিজ্ঞান।

বাংলাদেশে কয়েক হাজার পীর। পীর না বলে এদের প্রতারক বলা উচিত। তাবিজ, পাথর, ঝাড়ফুঁক, ‘জিন’ দিয়ে সব রকম অসুখ সারানোর গ্যারিন্টি দেয় এরা। কত লক্ষ মানুষ যে এদের প্রতারণার শিকার! সরকার কি নিরীহ নিরপরাধ মানুষদের এই পীর ফকির সাধু সন্ন্যাসী বাবা মাতাদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন না?

দেশের সরকার ধর্মের সমালোচনা করলে শাস্তি দেয়। মুক্তচিন্তকদের পিঠে চাবুক চালায়। চারদিকে ধর্মের গুণগান। খুব স্বাভাবিকভাবেই ধর্মে বিশ্বাস আসে মানুষের। ধর্ম যত বাড়ে, পীর বাবাও তত বাড়ে। মুক্তচিন্তার, যুক্তিবুদ্ধির কদর যে অঞ্চলে নেই, সে অঞ্চলে প্রতারকদের পোয়াবারো।পীর বাবায় ছেয়ে যায় গ্রাম গঞ্জ, শহর বন্দর।

তাদের প্রতারণার শিকার হতে থাকে সাধারণ মানুষ। উচ্চশিক্ষিত, ক্ষমতাশালী, বিত্তশালীরাও জড়ো হতে থাকে পীর বাবাদের পায়ে। এত বড় বড় লোকের ভক্তি দেখে পীর বাবাদের ওপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাস গভীর থেকে গভীরতর হয়।

ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রতারণার হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে তাদের অপকর্ম সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে, এই দায়িত্ব সকল সুস্থ সচেতন মানুষের, সকল মুক্তচিন্তকের।

সরকারের দায়িত্ব মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করা, কেউ যদি তারপরও অন্ধ হতে চায়, তাহলে নিজ দায়িত্বে অন্ধ হবে। সরকারের দায়িত্ব নয় মানুষকে অন্ধ হতে, যুক্তিবুদ্ধিহীন হতে সাহায্য করা। (বাংলাট্রিবিউন)
(লেখক: নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন)

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৬ : ০০ এএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার
ডিএইচ

Share