গুজবে আতঙ্কে শেষ হলো দূর্গা পূজা

রতন ভৌমিক প্রণয়, একজন কলেজ শিক্ষক। আর দশজন সনাতন ধর্শাবলম্বীর মতো তিনিও প্রত্যাশা করেছিলেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মহা ধূমধামের মধ্য দিয়ে পালন করবেন এবারের দূর্গা পূজা। কিন্তু শেষমেশ সেই প্রত্যাশা পুরণ হলো না তাঁর। পূজাতো করাই হলোনা তার উপর পূজার এই সময়টি কাটলো চরম উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা আর আতংকের মধ্যদিয়ে!

১৬ অক্টোবর শুক্রবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক নাতিদীর্ঘ পোস্টে মনের ভেতরে লুকায়িত কথা গুলো তুলে ধরেন রতন ভৌমিক প্রণয়। যেখানে উঠে আসে তাঁর মনের ভেতরের ক্ষোভ আক্ষেপ আর কষ্টের কথাগুলো।

শুধু একজন রতন ভৌমিক প্রণয় নয়, এই চিত্র কুমিল্লা শহরের সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। কুমিল্লা শহরের ঠাকুর পাড়ার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী চিন্ময়ী আচার্য্য বলেন, করোনার এই মহা দূর্যোগে দুটি বছরের আতস্কিত জীন থেকে মুক্তির আশায় অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম এবারের পুজোটা ধুমধাম করে পালন করবো। কিন্তু তা আর হতে দিলো কৈ? মহা অষ্টমীর সেই অনাকাঙ্খিত ঘটনার পর দুটি দিন বাসায় ভয় আর আতংকের মধ্যে কেটেছে। অবশেষে শহর ছেড়ে দাউদকান্দিতে মামাবাড়ী চলে এলাম পুজোটা করতে। কিন্তু পরিস্থিতি এখানেও ভালো ছিলো না। প্রতিবছর বোনের বাড়ীতে পুজা করতে ঢাকা থেকে আসা রণদা প্রসাদ সাহা বলেন, প্রতিবছর ঢাকা থেকে কুমিল্লায় আসি পুজার আনন্দ ভাগাভাগি করতে। ভেবেছিলাম মহা অষ্টমীর পর হয়তোবা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু কুমিল্লায় এসে দেখি পরিস্থিতি ভয়াবহ।

ফেসবুক পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, শেষ হয়ে গেল সনাতন ধর্মের বৃহত্তম আয়োজন দূর্গা পূজা। এবার একটা অনাকাংখিত ঘটনার কারনে একবারের জন্য ও দেবিদর্শন হলোনা বাসার কারো। কাউকে নিয়ে ঘুরতে কিংবা অঞ্জলী দিতে যাওয়া হলোনা। কারন মহা অষ্টমীর শিউলি ঝরা ভোরটা শুরু হলো এক মহাসংকট কাল হিসাবে। সারাটা দিন কাটলো এক অস্থির আতংকে। পাঁচ তলার বারান্দায় বসেই দেখলাম কিভাবে আমার প্রানের শহরে নেমে এল ভয়াবহ নিস্তব্ধতা।

তিনি লিখেন, কুমিল্লায় আছি আজ বিয়াল্লিশ বছর। সবার জীবনের আনন্দই আমারো আনন্দ এই তো ছিল আজীবন চাওয়া। আমার জানামতে এ পূজার আয়োজন সমস্ত হিন্দু পরিবারগুলোকে একটা যূথবদ্ধ অবস্থানে আনে। এ পূজার আনন্দ ভাগ করে নেয় সবাই। সেখানে হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ ছিলনা। কারন পূজার বাড়তি আকর্ষণ ছিল সবাইকে সাধ্যমত আপ্যায়ন।

কুমিল্লার বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে যাদের সাথে চলেছি, ঈদ ও পূজার আনন্দ ভাগ করে নিয়েছি তাদের নব্বই ভাগই ছিলেন মুসলিম। এখনো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বান্ধব ছিলেন বা আছেন তারাই। এখানে ধর্মটা কখনো আমাদের চলার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। পূজায় যাদের সাথে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরেছি তাদের প্রায় সবাই মুসলিমই তো ছিলেন।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত শত বন্ধুজন তাদের নিয়েইতো জীবন সুন্দর এবং প্রবহমান। সবাই হৈ হুল্লোরের মধ্যে কাটিয়ে দেই একেকটি উৎসব। একটা সামান্য বিশৃংখলা কি পারবে আমাদের সে চিরায়ত বন্ধন ক্ষুন্ন করতে? কোনদিনই না। নিশ্চয়ই সৃষ্ট সমস্যার একটা গ্রহনযোগ্য ও স্থায়ী সমাধান হবে।

পূজাটা হয়তো একটা উপলক্ষ ছিল মাত্র। কিন্তু এর পেছনে ছিল অন্য কোন উদ্দেশ্য। সবই সময়ে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু একটা দিন ইতিহাসের পাতায় কলংক লেপন করে দিয়ে গেল। মাঝখানে ঝড়ে গেল কিছু তাজা প্রাণ।

সবাইকে সবাইকে বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা জানিয়ে রতন ভৌমিক প্রণয় লিখেন, আসছে বছরের অপেক্ষায় রইলামন। নিশ্চয়ই আগামি দিনের প্রতিটি ঈদ, পূজা, পার্বন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে আমাদের মেলবন্ধন আরো দৃঢ় হবে।

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল, কুমিল্লা ব্যুরো: ১৫ অক্টোবর ২০২১

Share