বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের নামে দু’ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ দলের ও বঙ্গবন্ধু নাম ব্যবহার করার হিড়িক লক্ষ্য করা গেছে কয়েক বছর ধরে। সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নামে ২১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। এ ছাড়া দেড় শতাধিক স্কুল-কলেজ নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নামে। এর বাইরে মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নামে নামকরণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, একই নামে একই ধরনের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়।

বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়,আগের নাম একই রয়েছে,শেষে শুধু জেলার নাম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা করা হয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের ক্ষেত্রে সাধারণত কেউ জেলার নাম বলতে চায় না। যেকোনো অনুষ্ঠানে, চাকরিবাকরি বা বিদেশে পড়ালেখার ক্ষেত্রে নাম নিয়ে প্রতিনিয়ত জটিলতায় পড়তে হচ্ছে।

সূত্র মতে,শেখ হাসিনার দাদি সায়েরা খাতুনের নামেও রয়েছে মেডিক্যাল কলেজ। এ ছাড়া নামকরণ করা হয়েছে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রাসেল ও শেখ রেহানার নামেও।

বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নামে থাকা স্কুল-কলেজ জাতীয়করণেও অগ্রাধিকার দেয়া হয়। শুধু গত বছর বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামে ২৮টি স্কুল-কলেজ সরকারি করা হয়। এসব স্কুল-কলেজ জাতীয়করণে কোনো নীতিমালা মানা হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড.শেখ আব্দুর রশীদ বলেন,‘একই নামে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নামকরণে আইনি কাঠামো ঠিক করতে একটি কমিটি হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে বা সুপারিশ করবে। আমরা তা পাওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামকরণের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করব।’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫। এর বাইরে আরো ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আইন পাস হয়েছে। মোট ৬১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫টিই বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নামে। তবে ১৯৯৮ সালে রাজধানীর পিজি হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’ নামকরণ করা হয়। একই বছর গাজীপুরে স্থাপিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

এ ছাড়া গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (২০১০); ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (২০১৩); গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (২০১৬); নেত্রকোনায় শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় (২০১৮); জামালপুরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (২০১৮); বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট (২০১৮); লালমনিরহাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড এরোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় (২০১৯); বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ (২০২১); শেখ হাসিনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা (২০২১); বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর (২০২২); বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, নওগাঁ (২০২৩) নামকরণ করা হয়। এ ছাড়া ২০২৩ সালে আইন পাস হওয়া দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শরীয়তপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জ।

সূত্র জানায়, সরকারি ৩৭টি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নামে রয়েছে ছয়টি। সেগুলো হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ, ফরিদপুর; শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজ, গোপালগঞ্জ; শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ, টাঙ্গাইল; শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ, জামালপুর; শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ, হবিগঞ্জ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ, সুনামগঞ্জ।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর নামে ১০০টির বেশি স্কুল ও কলেজ রয়েছে। এর পরই শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে ১৭টি, শেখ রাসেলের নামে ১০টি, শেখ হাসিনার নামে ৯টি, শেখ রেহানার নামে একটি এবং তাঁদের পরিবারের নামে আরো বেশ কিছু স্কুল-কলেজ রয়েছে। বেশ কিছু কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামও রয়েছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি যেসব বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য আগেই আইন পাস করতে হয়। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নামেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পাস করা হয়েছে। আর স্কুল-কলেজগুলো সাধারণত বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের অনুকম্পা পাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের নাম ব্যবহার করেছে। এসবের অনেকগুলোই শুধু নামকরণের জন্য জাতীয়করণও করা হয়েছে।

ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড.এস এম এ ফায়েজ বলেন,‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামকরণ সরকারি সিদ্ধান্তে হয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আইন পাস হয়েছে। এখন সরকার যদি আমাদের কাছে এ ব্যাপারে মতামত চায় তাহলে পূর্ণ কমিশনে আলোচনা করে আমরা আমাদের মতামত জানাব।’

নামকরণে আইনি কাঠামো ঠিক করতে কমিটি : সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের বিষয়ে আইনি কাঠামো ঠিক করতে একটি উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করেছে অন্তর্র্বতী সরকার। গত ৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এই কমিটি গঠন করা হয়।

প্রজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এ কমিটি সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের বিষয়ে আইনি কাঠামো প্রণয়ন করে সরকারের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করবে। কমিটি প্রয়োজনে আরো সদস্য যুক্ত করতে পারবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা করবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে অসমতা : গত কয়েক বছরে দেশে বেশ কিছু নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। অনেক জেলা আছে, যেখানে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়েছে। এমনকি শহর ছেড়ে অনেক দূরে মফস্বলেও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। আবার অনেক জেলা আছে, যেখানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই। এতে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে অসমতা তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন,রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার তদবিরে যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর ফলে অনেক এলাকা অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। এতে অঞ্চলভিত্তিক শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

সূত্র জানায়, বৃহত্তর ফরিদপুরের পাঁচ জেলার মধ্যে শুধু গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ফরিদপুর একটি বৃহৎ ও প্রাচীন জেলা হওয়া সত্ত্বেও এখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এমনকি ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা দীর্ঘদিনের দাবি, কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যার হিসাবে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ঢাকা জেলা, এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০। এরপর দ্বিতীয় গাজীপুর জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় আছে পাঁচটি। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ চট্টগ্রাম ও খুলনা জেলায় চারটি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সূত্র : কালের কণ্ঠ

চাঁদপুর টাইমস রিপোর্ট
১০ অক্টোবর ২০২৪
এজি

Share