চাঁদপুর

সাহায্য মাত্র ২০ কেজি চাল দুশ্চিন্তায় জেলেরা

ডিম ছাড়া ও প্রজনন নিশ্চিত করতে মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর প্রথম প্রহর) রাত ১২টা থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ভোলা, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, চাঁদপুরসহ উপকূলীয় মেঘনা ও সাগর মোহনার ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

এ ২২ দিনের জন্য প্রতি জেলেকে ২০ কেজি চাল দেয়া হবে। কিন্তু ২০ কেজি চাল দিয়ে একটি পরিবার ২২ দিন কি করে চলেবে- তা নিয়ে জেলেদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তাই সাহায্যের পরিমাণ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন জেলেরা। এদিকে অনেক জেলে এনজিওদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি দিচ্ছিলেন।

মাছ ধরা বন্ধ থাকলে তারা কিস্তি দিতে পারবেন না। তাই এ সময় কিস্তি না নেয়ার দাবি জানিয়েছেন জেলেরা। যুগান্তরের ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

চাঁদপুর : জেলা শহরের পুরানবাজার রনগোয়াল এলাকার জেলে শরীফ বলেন, আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এ কারণে নৌকা ও জাল ডাঙায় উঠিয়ে রেখেছি। জেলে জহিরুল, মোক্তার হোসেন ও আরমান মিয়া বলেন, এ বছর এমনিতেও চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় বড় সাইজের কোনো ইলিশ পাওয়া যায়নি। ছোট সাইজের যে ইলিশ পাওয়া গেছে তা দিয়ে আমাদের খরচ উঠেনি। এখন উজানে ইলিশ এলেও নিষেধাজ্ঞার কারণে আহরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। এ সময়ের জন্য আমাদের ২০ কেজি চাল খাদ্য সহায়তা হিসেবে দেয়া হচ্ছে। এ চাল দিয়ে কি এতদিন চলা যায়?

বরিশাল : বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার জ্ঞানপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জেলে কাইয়ুম মাঝি বলেন, ‘৭ সদস্যের পরিবারে যেখানে প্রতিদিন ২-৩ কেজি চাল লাগে, সেখানে ২২ দিনে ২০ কেজিতে কি হবে? শুধু চালই তো নয়, এরসঙ্গে অন্যান্য বাজার-সদাইরও বিষয় আছে। কি করে টিকে থাকব বুঝতে পারছি না।’

শুধু কাইয়ুম-ই নয়, এ ২২ দিন তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় দক্ষিণ উপকূলের হাজার হাজার জেলে। প্রতি বছর মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময়ে মাটি কাটা আর রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ থাকে। করোনার কারণে এবার সেই সুযোগটাও নেই। সবারই এখন হাতে টান।

বাংলাদেশ মৎস্য শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের বরিশাল জেলার নেতা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জেলার ১০ উপজেলায় আমাদের হিসাবে জেলের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। অথচ সরকারিভাবে ২০ কেজি করে চাল পাচ্ছে ৪৭ হাজার জেলে। বাকিদের কি হবে? যতদূর জানি শুধু বরিশাল জেলা নয়, পুরো বিভাগেরই একই চিত্র।’

বরগুনা জেলা ফিশিং বোট ইউনিয়নের সভাপতি মান্নান মাঝি বলেন, ‘পুরো জেলায় ৩৭ হাজার জেলের তালিকা করা হয়েছে। সরকারিভাবে করা এ তালিকা অনুযায়ী প্রত্যেকে পাবে ২০ কেজি করে চাল। কিন্তু আমাদের হিসাবে সাগর পাড়ের এই জেলায় মৎস্যজীবী জেলের সংখ্যা ৫৫ থেকে ৬০ হাজার। তালিকার বাইরে যে জেলেরা রইল তাদের কি হবে?’

বরিশাল ইলিশ মোকামের আড়তদার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইন্দ্রজিৎ কুমার দাস বলেন, বিভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞার কারণে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে সামান্য হলেও সরকারি সাহায্য পান জেলেরা। কিন্তু এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ট্রলার মালিক, ব্যবসায়ী, বরফ কল মালিকসহ অন্যদের জন্য কোনো সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা নেই।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, নিষেধাজ্ঞার সময়ে সরকার বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ২ লাখ ৮২ হাজার ৫শ’ জেলেকে ২০ কেজি করে চাল দিচ্ছে। পাশাপাশি বরফ কল এবং মৎস্য আড়তসহ এ সেক্টরে যারা শ্রমিক আছেন তাদেরও সহায়তা দেয়ার চিন্তাভাবনা আমাদের আছে। এ সংক্রান্ত সুপারিশমালা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় আছে। তবে আড়তদার এবং ট্রলার মালিকদের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো চিন্তাভাবনা নেই।’

ভোলা : মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময়ে এনজিওর ঋণের কিস্তির টাকা আদায় বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছেন ভোলার জেলেরা। জেলেদের নেতা নুরুল ইসলাম মুন্সি, এরশাদ হোসেন বলেন, জেলে পরিবারগুলো গ্রামীণ জনউন্নয়ন সংস্থা, ব্র্যাক, আশাসহ বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে জাল ও নৌকা তৈরি করে থাকেন। করোনার সময়ে কিস্তির টাকা আদায় বন্ধ রাখতে সরকারের নির্দেশও মানেনি এনজিওগুলো। ইলিশের ভরা প্রজনন নিশ্চিত করতে ২২ দিন জেলেরা নদীতে নামতে পারবেন না। এ সময়ে এনজিওর ঋণের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। তাই চলতি মাসে কিস্তির টাকা আদায় বন্ধ রাখতে জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক জানান, জেলার ১ লাখ ২০ হাজার জেলের জন্য ২০ কেজি হারে ২ হাজার ৪০০ টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এছাড়া বেদে জেলেদের জন্য ৪ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। ওই চাল এ মাসের মধ্যে বিতরণ শেষ করা হবে।

লক্ষ্মীপুর ও রামগতি : জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, লক্ষ্মীপুরের ৭৬ কিলোমিটার ও চাঁদপুরের ২৪ কিলোমিটার মেঘনা এলাকায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এটি সফল করতে হাট-বাজারে লিফলেট বিতরণ, মাইকিং ও সেমিনার করা হয়েছে। একই সঙ্গে বরফ কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) : কুয়াকাটা-অলীপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আনছার উদ্দিন মোল্লা বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষণ করা গেলে মাছের উৎপাদন বাড়বে। যার সুফল পাবেন জেলেসহ ব্যবসায়ীরা। এটা বুঝতে পেরে কোনো জেলেই এখন আর অবরোধের মধ্যে মাছ শিকার করতে যাচ্ছে না। তবে এ সময়ে জেলেদের যে সহায়তা দেয়া হয়, তা খুবই অপ্রতুল। জেলেদের জন্য সহায়তা বাড়ানো উচিত।

বার্তা কক্ষ,১৪ অক্টোবর ২০২০

Share