দুর্গা শব্দের অর্থ- যিনি জীবের দুর্গতি হরণ করেন। আরেকটি অর্থ দুর্জ্ঞেয়। দুর্গা,মহিষমর্দিনী, শালিনী,পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারী, বাহারি, চণ্ডী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবানী, যোগনিন্দা প্রভৃতি নামে ও রূপে মায়ের পূজা হয়ে থাকে। যুগে যুগে বিভিন্ন সংকটের সময় তিনি মর্ত্যধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিভিন্ন রূপে,বিভিন্ন নামে। তিনি তাই আদ্যাশক্তি মহামায়া,ব্রহ্ম সনাতনী।
সম্পদ,মহারি, লজ্জা, পুষ্টি, শ্রদ্ধা, তুষ্টি, সবই মা দুর্গা। তিনি প্রলয় রাত্রি, তিনি নিয়তি তিনি সর্বময়ী ও শক্তিময়ী। মা প্রসন্ন হলে সব বিপদ কেটে যায়, আর মা রাগ করলে বিপদ ঘটে, মনের সব বাসনা বিফল হয়। মা শরণাগত সন্তানকে কল্যাণ কাজের শক্তি ও প্রেরণা দিচ্ছেন দশহাতে, সতত সর্বপ্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে অভয় দিচ্ছেন এবং সন্তানকে পরম লক্ষ্যে পরিচালিত করছেন।
হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা ‘দুর্গতি নাশিনী’ বা সব দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারিনী। দেবী দুর্গা হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরীর থেকে আগুনের মতো তেজরশ্মি একত্র হয়ে বিশাল এক আলোকপুঞ্জে পরিণত হয়। ওই আলোকপুঞ্জ থেকে আবির্ভূত এক দেবী মূর্তি। দেবী দুর্গা দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত আদ্যাশক্তি মহামায়া অসুরকুলকে একে একে বিনাশ করে স্বর্গ তথা- বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে শান্তি স্থাপন করেন। দশভুজা মায়ের দশটি হাত দশ দিকের প্রতীক। অর্থাৎ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই ঈশ্বর বিরাজমান। মা দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায়। তা হলো সৃজনী, পালনীয় ও সংহারী শক্তির প্রতীক। অর্থাৎ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতীক। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যিনি ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে পালন করেন, শিবরূপে তিনিই বিশ্ব প্রসারিণী, মাতৃরূপিণী শ্রীশ্রী দুর্গা।
আমাদের দেশে জাতীয়ভাবে এই উৎসবকে দুর্গাপূজা বা দুর্গা উৎসব হিসেবে অভিহিত করা হয়। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এটাকে শরৎকালের বার্ষিক মহোৎসব হিসেবে ধরা হয় বলে একে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় দিন থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত এই উৎসবকে মহালয়া, ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও দশমী নামে পালন করা হয়। অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ বলে, বসন্তকালের এই উৎসবকে বাসন্তি পূজা বা অকালবোধনও বলা হয়। দেবী মা দুর্গা ব্রহ্মশক্তি স্বরূপিণী, তিনি বিভাসিতা মাতৃশক্তি, তিনি জগজ্জননীরূপে সর্বভূতে বিরাজমান। তিনি সব প্রাণীতে চেতনারূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে, শ্রদ্ধা রূপে, দয়া ইত্যাদি রূপে বিরাজিতা।
দুর্গা নামের মানে হলো- ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়- শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। যে দেবী অগম্যা বা যাকে সহজে পাওয়া যায় না, তিনিই মা দুর্গা। চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি মা দুর্গা।
মায়ের পদতলে মহিষাসুর অশুভ এবং অহংকারের প্রতীক, যা জগতের অমঙ্গলের হেতু। ত্রিনয়নী মহাদেবী দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে আবির্ভূতা, এ পুজোর মূর্তি কল্পনায় ফুটে ওঠে শৌর্য-বীর্য (কার্তিক), জ্ঞান-ভক্তি (সরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ), সম্পদ (লক্ষ্মী) এবং মানবজীবনের ইহকালের বস্তুলাভ এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়। পুরোনো শাস্ত্রমতে দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়।
পূজার ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। অন্যদিকে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ কদলী বৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে বসানো হয়। একে বলে কলাবউ। পূজার অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে দেবীর বিশেষ পূজা হয়, যার নাম ‘সন্ধিপূজা’।
দুর্গা শক্তিদায়িনী। রাজভ্রষ্ট রাজা যুধিষ্টির বিপদ হতে মুক্তিলাভ করার জন্য মা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে মহাভারতের বিরাট পর্বের ২৪ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে। ‘মা’ নাম করলেই আমরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ভাব অনুভব করি। পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা তারই শক্তিতে শক্তিমান হয়ে তাকেই লাভ করার চেষ্টা করি।
কুমারী পূজা : প্রতি বছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে নবমী পূজার দিনও এ পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে। পুরাণ মতে, দেবগণের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়। সনাতন ধর্ম মতে, কুমারী পূজা হলো ১৬ বছরের কম বয়সী অরজাঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। শারদীয় দুর্গাপূজার অংশ হিসেবে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশে সুপ্রাচীন কাল থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন চলে আসছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্ণনানুসারে, কুমারী পূজায় কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে কোনো কুমারীই পূজনীয়। তবে সাধারণ ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত।
দুর্গা যেন সব জগতের প্রতীক, দুর্গাপূজা সমাজের সব বর্ণ, শ্রেণি ও পেশার সব স্তরের মানুষের মিলনমেলা ও উৎসব। সবার কল্যাণ ভাবনা ও প্রেরণার উৎস। মায়ের ডান পাশে রয়েছেন লক্ষ্মী ও গণেশ, বাঁ পাশে সরস্বতী ও কার্তিক। গণেশ সিদ্ধিদাতা ও গণঐক্যের, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। দেবী দুর্গা জগৎরূপে আমাদের আহার্যের সংস্থান করে আমাদের রক্ষণ ও প্রতিপালিত করছেন। দুর্গা যেন সমস্ত জগতের প্রতীক। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বলা হয়েছে, তিনি আমাদের বুদ্ধিরূপে, নিদ্রারূপে, ক্ষুধারূপে, তৃষ্ণারূপে, ক্ষন্তিরূপে ইত্যাদি জীবন প্রকাশের যাবতীয় শক্তির উৎস, তার অস্তিত্বেই আমরা চেতনাবান, তার শক্তিতেই আমার শক্তিমান।
শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার মূল মন্ত্র: যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ, যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ, যা দেবী সর্বভূতেষু শন্তিরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।
মাতৃরূপিণী মহাশক্তির শরণাপন্ন হলে, মা সন্তানের জন্য কল্যাণকর যথার্থ অভীষ্ট প্রদান করেন। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে তার স্তুতি করে বলা হয়েছে- হে দেবী আপনি স্বর্গ ও মুক্তিদায়িনী, মা আমাদের শত্রু বিনাশ করিয়া তুমি আমাদিগকে বিপদ হইতে এতদিন বাঁচিয়েছ। তেমনি ত্রিভুবনের সব দুঃখ বিপদও তুমিই সব সময় দূর করিও, এ আমাদের প্রার্থনা। মা দুর্গা জগৎ জুড়িয়া আছেন। সব প্রকার, অকল্যাণের হাত থেকে তিনি আমাদের অর্থাৎ- তার সন্তানদের রক্ষা করে থাকেন। শাস্ত্রমতে, দেবতা ও অসুরদের সংগ্রামে শরণাগত শুভবুদ্ধি ও কল্যাণকামী দেবতাদের তিনি সব সময় বরাভয় দান করেছেন। তিনিই সমস্ত শক্তি ও গুণের আধার স্বরূপিণী।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড.অরূপরতন চৌধুরী, একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দ সৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র্ । ২৩ অক্টোবর ২০২৩