চাঁদপুর টাইমস ডট কম :
সংযুক্ত আরব আমিরাত ফেরত কুষ্টিয়ার ‘এস’ আদ্যক্ষরের নারী কর্মী শুধু দুবাইয়ে গিয়েই দেহ ব্যবসায় বাধ্য হননি। এর আগে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনের পাশবিকতারও শিকার হন তিনি। আর দুবাইয়ে গিয়ে প্রথম আনোয়ার হোসেনের আত্মীয় সাইফুল ইসলামের পাশবিকতার শিকার হন ওই নারী। এরপর তার ওপর নেমে আসে ধারাবাহিক পাশবিক নির্যাতন।
হতভাগ্য এ নারীকে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা নিয়ে এর আগেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এরপর আদালত পল্টন থানাকে অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেনসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
‘এস’ আদ্যক্ষরের ওই নারীকে কীভাবে দালালরা দেহ ব্যবসায় বাধ্য করেছেন তিনি তা বিস্তারিত বলেছেন। তিনি বলেন, গত ৯ জুন তার দুবাইয়ে যাওয়ার দিন নির্ধারিত হয়। এর আগের দিন ৮ জুন মিনার ট্রাভেলসের মালিক আনোয়ার হোসেনের কথা মতো আমার স্বামী কবির হোসেনকে নিয়ে বিকেলে ফকিরাপুলে ওই ট্রাভেলসের অফিসে হাজির হই। সন্ধ্যার দিকে আনোয়ার আমার স্বামী কবিরকে বলেন, ‘অনেক দূর থেকে এসেছেন, আপনি চলে যান। আপনার স্ত্রী এখানেই অন্যদের সঙ্গে থাকবে। বিদেশে যাচ্ছে- ভাষাসহ আরও অনেক কিছু জানা দরকার তার। কাল ফ্লাইট, রাতের মধ্যে এ সব শিখাতে হবে। আনোয়ারের কথায় চলে যান আমার স্বামী।’
তিনি বলেন, রাতে তার (আনোয়ার) অফিসের একটি রুমে সোফাতে ঘুমাতে দেওয়া হলো আমাকে। এ সময় অফিসে আর কাউকে দেখিনি। রাত ১১-১২টার দিকে আনোয়ার আমার কাছে এসে শরীরে হাত দেয়। আমি বাধা দিয়ে বলি, এ কি করছেন আপনি। তিনি তখন বলেন, বেশি কথা বল না। আমি যা বলি শোন। তুমি কি জান তোমাকে কত কষ্ট করে ওখানে পাঠাচ্ছি। একটা ভিসা করতে কত কষ্ট হয়? কত টাকা খরচ হইছে তোমার পিছে?
‘এস’ আদ্যক্ষরের ওই নারী বলেন, আমি তাকে বলি- টাকা তো আমরা আপনাকে দিয়েছি। আপনার কিসের খরচ অইছে? আনোয়ার তখন বললেন, ‘তোমার টাকা তো দালাল সব খেয়ে ফেলেছে। আমি তখন বললাম- আমার বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই। আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তখন আনোয়ার বলেন- ঠিক আছে শুয়ে থাক। এর কিছুক্ষণ পর আনোয়ার আমাকে পাজা করে মুখ চিপে ধরে রাখে। বলে কথা বলবি না। তোকে বিদেশে পাঠাচ্ছি কি এমনি এমনি? এ সব করতে হবেই। তার কাজে বাধা দিলে আমাকে থাপ্পড় মারে। শেষমেশ আমার সঙ্গে খারাপ কাজ করলো সে। –এ কথা বলে কেঁদে ফেললেন ‘এস’।
ভুক্তভোগী নারী বলেন, পরদিন আমাকে দুবাই পাঠিয়ে দেয় আনোয়ার। দুবাই বিমানবন্দরে নামার পর একটি লোক আমাকেসহ ১২-১৩ জনকে গাড়িতে করে সাইফুল নামে এক বাংলাদেশি দালালের অফিসে নিয়ে যায়। ‘সাইফুল কে?’ -জানতে চাইলে ‘এস’ বলেন- সে আনোয়ারের শালা কি সুমুন্দি হবে। ওই দেশের বাংলাদেশি দালাল। আনোয়ারের মাধ্যমেই ওই দেশে সাইফুল মেয়ে মানুষ নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়।
‘এস’ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদেন আর তার সম্ভ্রম হারানোর চাপা কষ্ট খুলে বলেন। তিনি বলেন, আমাকেসহ সবাইকে সাইফুলের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন অফিসে মেয়েদের সাপ্লাই করে দেওয়া হয়। সাইফুল আমাকে বলল- এখন তো রাত হয়ে গেছে, কাল তোমার মালিকের কাছে তোমাকে বুঝিয়ে দেব। আমি বললাম- আমি খুব ক্লান্ত, আমাকে একটু শুইতে দেন। অফিসের বাথ রুমের কাছে একটি বড় রুম আছে। ওখানে আমাকে পাঠিয়ে দিল। গভীর রাতে সাইফুল আমার শরীরে হাত দিল। আমি বাধা দিলাম- বললাম দেশেও আনোয়ার আমার উপর অত্যাচার করেছে। আপনি আমার বাপ হন। দোহাই আমার উপর দয়া করেন। আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সে বলল- ঠিক আছে, তোমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব। কিন্তু তোমার সঙ্গে…। আমি বাধা দিলাম। বললাম অফিস থেকে বেরিয়ে যাব। সে বলল- তুমি এখান থেকে বেরিয়ে বাঁচবে না। সাইফুলও আমার সঙ্গে খারাপ কাজ করল।
চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে তার। কান্না জড়িত কণ্ঠেই বলে গেলেন তার দুবাইয়ে দেহব্যবসার নির্মম কাহিনী। তিনি বলেন, সাইফুল সকালে নাইজেরিয়ান নাকি কোন দেশের এক দালালের কাছে ওই দেশের ১০ হাজার টাকায় বেচে দিল আমাকে। একটি গাড়িতে করে তিনতলা এক বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল। চারিদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখি- ছোট ছোট কাপড় পরে কত মেয়ে বসে আছে। বাংলাদেশি এক মহিলা, সে নিজেকে সাইফুলের বউ পরিচয় দিয়ে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল। বলল- এখানে কেঁদে কোনো লাভ নেই। তোমাকে এ সব করার জন্যই আনা হয়েছে। যেহেতু সে বাঙালি তাই তাকে বললাম- আপনার স্বামী আমার উপর রাতে এই আচরণ করেছে। সে বলল- নো প্রবলেম। এ সব হয়েই থাকে। সাইফুলের বউ আমারে নাইজেরিয়ান এক মহিলার হাতে তুলে দিল। তারা সবাই মিলে আমারে একটা রুমে ঢুকিয়ে দেয়। দেখি ইয়া বড় বড় কালো কয়েকজন পুরুষ লোক নেংটা হয়ে বসে আছে। আমি থাকতে চাইলাম না। তারা আমারে মারধর করতে করতে দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। একে একে সবাই আমার উপর নির্যাতন চালাল। আমি সেন্সলেস হয়ে পড়লাম। এভাবে ৮ দিন কিভাবে যে কেটেছে তা বলতে পারব না। তাদের কথা না শুনলে আমার উপর অমানসিক নির্যাতন নেমে আসতো। তারা বলে তোকে এত টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। এ সব তোকে করতেই হবে। ওখানে যে কয়েকদিন ছিলাম- একটা দিন একটা সেকেন্ডও আমাকে শান্তিতে রাখেনি। এ কয়েকদিন ঠিক মত আমাকে খাবারও দেয়নি তারা। আমার জীবনটাই শেষ করে দিয়েছে। স্বামী আমার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কালাম পড়ে। সে কী আমারে রাখবে? আমি কী তার কাছে থাকতে পারব?
‘কেন বিদেশে গেলেন?’ জানতে চাইলে ‘এস’ বলেন, ছোটবেলায় মা মরে গেছে। নানার কাছে বড় হইছি। নানা তার সম্পত্তি তিন খালার নামে লিখে দিছে। আমি তারে বলেছিলাম আমি এতিম মানুষ, আমার কেউ নাই, এক কাঠা লিখে দাও। দেয়নি। আমি তখন বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করি। অনেকেই তো যাচ্ছে- টাকা পয়সা আনছে। নানাকে বললাম, আমি বিদেশে যাব। টাকা কামাই করে জমি কিনে বাড়ি করবো। নানার উপর জিদ করে আমি এই কাজ করেছিলাম। আমি তো আর জানতাম না জীবনটা আমার শেষ হয়ে যাবে। আমি তাও বাইচা জীবন নিয়ে ফিরে এসেছি। ওখানে পাখি, সুমি, রাজিয়াসহ ৭ জন বাংলাদেশি মেয়ে আছে। ওদের কান্না দেখলে তো আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠবে। ওদের দিয়ে এ সব খারাপ কাজ করাইছে। ওখান থেকে আসমা নামে কুষ্টিয়ার একজন ফিরে আসছে।
‘আপনি কিভাবে ফিরে এলেন?’ জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, একজনের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে আমার স্বামীকে ফোন দিয়েছিলাম। সে ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে কথা বলে। ওই নরক থেকে সাইফুল ৮ দিন পর আমাকে তার অফিসে নিয়ে যায়। আমার সঙ্গেও পুলিশ কথা বলে। আমার স্বামী টাকা পাঠায়- আমাকে ফিরিয়ে আনে।
‘আপনার সঙ্গে আনোয়ারের পরিচয় কীভাবে?’- ‘এস’ বলেন- আনোয়ারের সঙ্গে আমাদের কোনো চেনাজানা ছিল না। পরিচয় ছিল ধোলাইপাড়ের দেলোয়ার কালা দালালের সঙ্গে। সে আমারে আনোয়ারের মাধ্যমে দুবাইয়ে নিতে ক্লিনার ভিসা করে দেয়। সরকারিভাবে আমাকে এক মাস ট্রেনিংও দেয়। আমাকে সার্টিফিকেটও দেয়। সরকারিভাবে গেলাম- এরপরেও আমারে বেঁচে দিল। আমার লাইফ শেষ করে দিল। আমি বাঁচুম না। মরে যামু। আমার ছেলে মেয়ে হয় না। বাবা-মাও নাই। ভাই, এমন কিছু করেন যাতে ওরা মইরা যায়। ওরা আমাদের জীবনকে শেষ কইরা দিল।
অঝোরে কাঁদতে থাকেন দুবাই ফেরত হতভাগ্য ওই নারী।
তবে মিনার এয়ার ট্র্যাভেলসের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন তার বিরুদ্ধে ‘এস’ আদ্যক্ষরের ওই নারীর সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আনোয়ার বলেন, ‘আমার অফিসে রাতে কোনো লোক থাকতে পারে না। থাকার কোনো নিয়মও নেই। রাত ৯টার পর অফিস বন্ধ থাকে। এক দিন শুধু সে ফিঙ্গারিং করতে আমার অফিসে এসেছিল। এরপর আর আসেনি।’
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি মুসলমান- সেও মুসলমান। আমি একটা ব্যবসা করি, আমার ক্ষতি করে আপনাদের কোনো বেনিফিট নাই। পত্রিকায় উঠিয়ে কিছু ব্যবসা করতে পারবেন, এই তো। আপনারা বেশি না পেঁচিয়ে ওকে নিয়ে আসেন, মসজিদে ঢুকাইয়ে কুরআন শরিফ হাতে নিয়ে শপথ নেওয়ান- বিষয়টি সঠিক কিনা। এর বাইরে কোনো ফাংশনে যাবেন না। এ ছাড়া কেস কারবারে গেলে তো ভিন্ন কথা।’
আনোয়ার বলেন, ‘ও’ (‘এস’ এর স্বামী কবির) কী আসলে বিদেশ পাঠানোর জন্য এ সব করে নাকি মানুষকে ব্লেইম দিয়ে টাকা পয়সা উদ্ধারের চেষ্টা করে। ওই মহিলার হাজবেন্ডকে না দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন না। ওর হাজবেন্ড ঝালকাঠির আওয়ামী লীগের নেতা। এত বড় নেতা হয়ে তার ওয়াইফকে বিদেশ পাঠায় কেন?’
তিনি বলেন, ‘আমাকে ব্লেইম দিয়ে চক্রান্ত করে টাকা নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে তারা। সঠিক তথ্য নেওয়ার থাকলে নেন। আর কোনো মহিলা ধর্ষণ হলে গোপন রাখতে চায়। সে এভাবে প্রচার করছে যে- তার মানসম্মানও নাই। দরকার হলে আমি জেলে যাব- তবে, আমি আমার পথে সঠিক আছি।
‘একজন ধর্ষিত না হলে এ সব কী এমনি এমনি বলতে পারে?’-প্রশ্নে আনোয়ার বলেন- ‘আপনিই চিন্তা করেন কেউ বলতে পারে কিনা। ওর তো গোপন রাখার দরকার ছিল। ৯ তারিখে পাঠাইছি- ১৫ তারিখে ওর স্বামীকে ফোন করেছে, ২৭ তারিখে দেশে ফেরত আসছে। এ কয়েকদিনের মধ্যেই এত ধর্ষিত হয়ে গেল সে? আল্লাহই জানে কি হইছে।
আনোয়ার আরও বলেন, ‘যদি সে ধর্ষিত হতো তাহলে তাকে ২২ হাজার টাকা দিয়ে দেশে আনতাম না- আমিও পালিয়ে থাকতাম।’
দুবাইয়ে অবস্থানরত সাইফুল ইসলাম আপনার আত্মীয় কিনা জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘না- তিনি ওখানে ব্যবসা করেন।’
আদালত আপনাদের নামে মামলা নিতে পল্টন থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন, বিষয়টি জানেন কিনা? জানতে চাইলে আনোয়ার বলেন, এ ব্যাপারে কিছুই জানি না।’
এদিকে মামলা এজহার হিসেবে গ্রহণ করতে আদালতের নির্দেশের কপি এখনও পল্টন থানায় পৌঁছেনি বলে জানিয়েছেন দুবাই ফেরত ওই নারীর আইনজীবী বাবুল হাওলাদার। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবারের পর দুই দিন ছুটি, তাই আগামী রবিবার দুপুরের মধ্যে আদালতের অর্ডার থানায় পৌঁছবে।
প্রসঙ্গত, গত ৯ জুন সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান কুষ্টিয়া সদরের হতভাগ্য ওই নারী। তিন দিনের মাথায় স্বামী কবির হোসেনকে ফোনে তার উপর নির্যাতনের কথা জানিয়ে দেন। পরে কবির পল্টন থানা পুলিশের মাধ্যমে মিনার এয়ার ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনকে চাপ দিয়ে ‘এস’কে দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। গত ২৭ জুন ‘এস’ আদ্যক্ষরের ওই নারী দুবাই থেকে দেশে ফিরে আসেন।
ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত ১ জুলাই তাকে রিলিজ দেয় চিকিৎসক। ডাক্তারী ছাড়পত্রে দুবাই ফেরত এই নারী ‘সেক্সুয়াল অ্যাসাল্ট’র শিকার বলে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে দুবাইয়ে পাচারের অভিযোগে মিনার এয়ার ট্র্যাভেলসের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে গত সোমবার মামলা করতে যান ওই নারীর স্বামী। তবে পুলিশ মামলা নেয়নি বলে অভিযোগ করেন কবির। পরে বৃহস্পতিবার ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন বিশেষ দমন আদালত-১ এ মামলা করতে গেলে বিচারক এনামুল হক ভুইয়া পল্টন থানাকে সরাসরি মামলা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত যাদের নামে মামলা নেওয়ার নির্দেশ দেন তারা হলেন- মিনার এয়ার ট্র্যাভেলসের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনে, দেলোয়ার হোসেন, সাইফুল, মোতালেব হোসেন, সাঈদ হোসেন ও শেখ নিজামুল কবির (নিজাম)।
চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/২০১৫