দুই শিশুর আকুতিতে মা-বাবা, আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীদের চোখে পানি

১২ বছর আর ৯ বছরের দুই শিশু কাঁদছে। তাদের একই কথা ‘আমরা আর কিছু চাই না। শুধু মা-বাবাকে একসঙ্গে দেখতে চাই। তাঁদের সঙ্গে থাকতে চাই।’ দুই শিশুর এ কান্না ও আকুতিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি তাদের মা-বাবা, বিচারপতি, আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মীসহ উপস্থিত অনেকেই।

বিয়ে বিচ্ছেদ হলেও শেষ পর্যন্ত শিশু দুটির কান্নায় মা-বাবাও বলতে বাধ্য হলেন, তাঁরা আবার একসঙ্গে সংসার করতে চান।

গতকালের এ ঘটনাটি ঘটেছে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চে। আদালত দুই শিশুকে আপাতত বাবার হেফাজত থেকে নিয়ে মায়ের হেফাজতে দিয়েছেন। তবে শিশু দুটির কাছে অবাধে যেতে পারবেন তাদের বাবা। এ বিষয়ে আগামী ৪ জুলাই পরবর্তী আদেশ দেওয়া হবে। আদালতে দুই শিশুর বাবা মিয়া মো. মেহেদী হাসানের আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট তাপস বল। মা কামরুন নাহার মল্লিকার পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ও অ্যাডভোকেট এ কে এম রিয়াদ সলিমুল্লাহ।

কামরুন নাহার মল্লিকা রাজশাহীর শাহ মকদুম উপজেলার মেয়ে। ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে অধ্যয়নকালে তাঁর পরিচয় হয় মেহেদীর সঙ্গে। তিনি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার বাসিন্দা। পড়তেন ঢাকা কলেজে। পরিচয় থেকে দুজনের প্রেম। দুই পরিবারের সম্মতিতে ২০০২ সালে বিয়ে করেন তাঁরা। লেখাপড়া শেষ করে মেহেদী হাসান যোগ দেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। আর মল্লিকা চাকরি নেন রাজধানীর ধানমণ্ডির একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। তাঁদের দুই ছেলে সালিম সাদমান ধ্রুব (১২) ও সাদিক সাদমান লুব্ধক (৯)।

বিয়ের ১৫ বছর ২০১৭ সালের ১২ মে বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে তাঁদের। স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার এক সপ্তাহ আগে দুই সন্তানকে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার উমেদপুর গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন মেহেদী হাসান। এরই মধ্যে কেটে গেছে একটি বছর।

মল্লিকার অভিযোগ, বারবার চেষ্টা করেও তিনি সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। এ কারণে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন। নিজের হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানি শেষে শিশু দুটিকে হাইকোর্টে হাজির করতে গত ২৯ মে নির্দেশ দেন আদালত। ২৫ জুন তাদের হাজির করতে মহম্মদপুর থানার ওসি ও শিশু দুটির বাবা মেহেদী হাসানকে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে দুই সন্তানকে কেন মায়ের হেফাজতে দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। আদালতের এ নির্দেশে পুলিশ শিশু দুটিকে গতকাল হাইকোর্টে হাজির করে। শিশু দুটির মা-বাবা, মামা, নানি, ফুফুসহ আত্মীয়-স্বজন আদালতে হাজির হয়। শুরু হয় দুই পক্ষের আইনজীবীর শুনানি।

মায়ের আইনজীবী আদালতে বলেন, মা তাঁর সন্তানদের সঙ্গে পাঁচ মিনিটের জন্য কথা বলার সুযোগ চান। কিন্তু ফুফুর কারণে কথা বলতে পারছেন না। এরপর আদালত কথা বলার অনুমতি দিলে মা শিশু দুটির কাছে যেতেই মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজুড়ে দেয়। এক বছরেরও বেশি সময় পর মাকে কাছে পেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে ৯ বছরের শিশু সাদিক সাদমান লুব্ধক অভিযোগ জানায়, ‘তুমি কেন ঈদে আমাকে ফোন করোনি?’ কাঁদতে কাঁদতে মা জবাব দেন, ‘ফোন করেছিলাম। তোমাদের চেয়েছিলাম। কিন্তু ওরা আমাকে দেয়নি।’

প্রকাশ্য আদালতে এ ঘটনা সবার মনে নাড়া দেয়, ছুঁয়ে যায়। যুক্তি-পাল্টাযুক্তির আদালতে তৈরি হয় আবেগঘন এক পরিবেশ। এরই মধ্যে বড় ছেলে ধ্রুব এক হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বাবাকে ডাকতে থাকে। কিন্তু তিনি কাছে যাচ্ছিলেন না। এটা দেখে আদালত তাঁর বাবাকে শিশুটির কাছে যেতে নির্দেশ দেন। বাবা কাছে যাওয়ার পর শিশুটি তাঁকে বলে, ‘বাবা, তুমি মাকে সরি বলো। এরপর মাকে বলে তুমিও বাবাকে সরি বলো। আমরা আর আলাদা থাকতে চাই না। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই।’

এ পর্যায়ে আদালত শিশু দুটিকে এজলাসের কাছে ডেকে নেন। শিশু দুটির বক্তব্য শুনতে চান আদালত। এ সময় বড় ছেলে ধ্রুব আদালতকে বলে, ‘আমরা বাবা ও মাকে একসঙ্গে দেখতে চাই। আমরা দুজনকেই চাই।’ বড় ভাইয়ের সঙ্গে সুর মেলায় ছোট ভাই লুব্ধকও।

এ সময় আদালত বলেন, ‘তোমরা জোরে জোরে বলো। তোমরা একসঙ্গে থাকতে চাচ্ছ। তোমাদের বাবা-মার শিক্ষা হোক।’ এরপর আদালত তার মা-বাবাকেও ডেকে নেন। সেখানেও ছেলে দুটি মা-বাবাকে পরস্পরকে হাত ধরার অনুরোধ জানাতে থাকে। একপর্যায়ে বড় ছেলে তার মা ও বাবার হাত নিয়ে একসঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে বলতে থাকে, ‘তোমরা আলাদা হয়ে গেলে কেন? আমরা আর কিছু চাই না। আমরা তোমাদের সঙ্গে থাকতে চাই।’

এমন পরিস্থিতিতে আদালত মা-বাবাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এটা দেখেও কি আপনাদের মন গলে না! আপনারা কি সন্তানের জন্য নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবেন না? সন্তানের স্বার্থের চেয়ে আপনাদের ইগো বেশি হয়ে গেল? সামনে তাকিয়ে দেখুন, আপনাদের এ দৃশ্য দেখে সবার চোখ দিয়েই পানি পড়ছে।’

এরপর বিচারক খাসকামরায় গিয়ে মা-বাবা, ফুফু ও নানিকে ডেকে নিয়ে একান্তে কথা বলেন। এরপর এজলাসে উঠে আদালত আদেশ দেন, শিশু দুটির ইচ্ছা তাদের মা ও বাবা একসঙ্গে থাকবেন। এ কারণে আপাতত তারা মায়ের হেফাজতে থাকবে। আগামী ৪ জুলাই পরবর্তী আদেশ দেওয়া হবে। এরপর আদালত ধ্রুবকে ডেকে বলেন, বাসায় তোমার মা-বাবা কী করেন, তা জানাবে। এরপর আদালত পুলিশকে শিশু দুটিকে মায়ের হেফাজতে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

পরে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ধারণা বাচ্চাদের আকুতি হয়তো বাবা ও মায়ের মনে দাগ কেটেছে। এ কারণেই হয়তো মা-বাবা তাঁদের দাম্পত্য জীবনের কলহ ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।

আদেশের পর কামরুন নাহার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি আমার সন্তানদের পেয়েছি। আমি খুশি। এর থেকে বেশি কিছু বলার ভাষা নেই।’

মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমার সন্তানেরা খুশি। এরপর আমার আর কিছু বলার নেই।’ -কালেরকণ্ঠ

বার্তা কক্ষ

Share