জাতীয়

দুই মন্ত্রীকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করলো আদালত

আপনারা শপথ ভঙ্গ করেছেন, এর পরিণতি কী হবে?

আদালত অবমাননার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে উপস্থিত হওয়া দুই মন্ত্রীকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেছেন আদালত। দুই মন্ত্রীর উপস্থিতিতেই শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা) তাদের উদ্দেশ করে বলেন, যত বড় ক্ষমতাধর হোন না কেন আইন সোজা পথে চলে। আমরা অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যে কোনো আদেশ দিতে দ্বিধাবোধ করবো না। আপনারা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে তা ভঙ্গ করলে পরিণতি কি হবে?

ক্ষমা চেয়ে আবেদন করা দুই মন্ত্রীর মধ্যে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের ব্যাখ্যা গ্রহণ করেননি আদালত। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের ব্যাখ্যা আংশিক গ্রহণ করেছেন। পরে কামরুল ইসলামের আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য আদালতে সময় চান। আদালত তার সময় আবেদন গ্রহণ করে আগামী ২৭ মার্চ দুই মন্ত্রীর উপস্থিতিতে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন।

রবিবার সকালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননার অভিযোগ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। কামরুল ইসলামের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার এবং আ ক ম মোজাম্মেল হকের পক্ষে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক শুনানি করেন।

প্রধান বিচারপতি পরে তাদের উদ্দেশ করে বলেন, সংসদে ও টকশোতে রাজনীতিবিদরা আমাদের শুনানি নিয়ে নানা মন্তব্য করেন। দুজন মন্ত্রী ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, এই কোর্ট সংবিধানের অঙ্গ। সরকারের অঙ্গ নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। মন্ত্রী শুধু প্রধান বিচারপতিকে ছোট করেননি, গোটা বিচার বিভাগকে পদদলিত করেছেন। প্রধান বিচারপতিকে এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে কিনলেও অন্য চার বিচারপতিকে কেনা সম্ভব নয়। প্রধান বিচারপতি একা কোনো রায় দেন না।

পরে প্রধান বিচারপতি বলেন, মন্ত্রীকে প্রশ্ন করি। আপনিতো কাসেমের (মীর কাসেম) রায় পড়েছেন। কাসেমের রায়কে প্রভাবিত করতে মন্তব্য করেছেন কিনা আমার সন্দেহ হয়। প্রধান বিচারপতি ও বিচার বিভাগকে স্ক্যান্ডালাইজ (কলঙ্কিত) করেছেন। প্রধান বিচারপতি যদি আদালত অবমাননার মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাহলে লাখ লাখ মামলার কি হবে?

তারপর কামরুলের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার ব্যাখ্যা হয়নি। এটা আমরা রিজেক্ট করলাম। পড়ালেখা করে আসেন। আপনার জবাব (প্যারা ৫) সাঙ্ঘাতিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ।

আর রফিক উল হককে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি জনকণ্ঠের রায় পড়েছেন? সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানতে কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কিনা?

প্রধান বিচারপতি এরপর তাদের উদ্দেশে বলেন, বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ ফৌজদারি অবমাননা। ডাকাতি মামলার আসামির যেমন রকম ফোজদারি অপরাধ, এটাও একই অপরাধ। জনকণ্ঠের মামলায় বলে দিয়েছি।

দুই মন্ত্রী শপথ ভঙ্গ করেছেন এমন মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, আপনি স্বীকার করেছেন অপরাধ করেছেন। আপনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। এখন কি হবে? টকশোতে যাবেন বাড়াবাড়ি করবেন। এটা আর দেখতে চাই না। সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ পড়েন। আপনি সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। আপনি শপথ লঙ্ঘন করলে এর পরিণতি কি হবে?

দেশ চলতে হলে সংবিধান রক্ষা করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী দেশ চলবে। তারা কি ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছে। একজন প্রসিকিউটর রায় নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যানকে দেখিয়েছেন। জানতে চেয়েছেন ঠিক আছে কিনা? তিনি বলেছেন রায় ঠিক আছে। আপনারা সুপ্রিম কোর্টকে কোথায় নিয়ে গেছেন? কোন লেভেলে নিয়ে গেছেন?

প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, আমরা তো সংবিধানের বাইরে রায় দিতে পারি না। আমরা সংবিধানের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় করতে পারি না। আপনি শপথ নিয়েছেন। আপনার স্বীকার করা আর জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের অপরাধ এক কিনা? দোষ স্বীকার করার পর কী হতে পারে। একজন অপরাধীকে যখন ডেকে আনা হয়, বলা হয়- তুমি দোষী না নির্দোষ? যখন সে বলে দোষ স্বীকার করছি ক্ষমা করেন। তখন কোর্ট কি করবে?

রফিক উল হক জবাবে বলেন, সিম্পল পানিশমেন্ট দিতে পারে। আমি তো অন্যায় করেছি মাফ চেয়েছি।

পরে বাসেত মজুমদার বলেন, মার্সি যখন চাই তখন তো দোষ স্বীকার করে চাই। আমরা ক্ষমা চেয়েছি। পুরো বিষয়টি আদালতের হাতে।

বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া বলেন, আমাদের প্রথা হচ্ছে ক্ষমা দুই লাইনে চাইতে হয়। হোয়াট ইজ দিস? আপনারা বিশাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশে কারা মুক্তিযোদ্ধা। কার কি ভূমিকা। প্রধান বিচারপতি যদি ওই মামলা (মীর কাসেম) থেকে নিজেকে তুলে নিলে দেশে রায়ট (দাঙ্গা) লেগে যেত। পুরো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল হয়ে যেত। এখানে আমরা অনেক সিদ্ধান্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে।

বাসেত মজুমদার বলেন, আমরা যথাযথভাবে আবেদন দেব। সময় চাই।

প্রধান বিচারপতি তাকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার মক্কেলকে সুরক্ষা দিতে না পারলে আদালতে আসবেন না। আপনারা যতই ক্ষমতাধর হোন না কেন আইন সোজা চলে। আঁকাবাঁকা পথে চলে না। আমরা অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যে কোনো আদেশ দিতে কুণ্ঠাবোধ করবো না। আপনি যেই হোন।

এ কথা বলে আদালত সময় আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ২৭ মার্চ সকাল ৯টায় এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।

Share