স্বাধীন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। এ দীর্ঘ সময়ে দলীয় আদর্শ ও নেতৃত্বের বিকাশে দলটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। পরিবারিক চরম বিপর্যয় এবং বাকশালের রাজনৈতিক ধ্বংসস্তূপ থেকে আওয়ামী লীগকে শেখ হাসিনা যেভাবে আজকের দৃঢ় অবস্থানে নিয়ে এসেছেন; ক্ষমতায় থেকেও বিএনপি সেটা করতে পারেনি। একদলীয় বাকশালকে ত্যাগ করে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে নিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করেছেন এবং একবিংশ শতাব্দীর উপযুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা মানুষের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রচার করেছেন।
বিএনপি জিয়ার ১৯ দফা দলীয় আদর্শকে পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং সমকালীন বাস্তবতায় উত্তীর্ণ করতে পারেনি। বেগম জিয়া নেতৃত্বের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের শূন্যতা পূর্ণ করেছেন বটে; আদর্শিক অনুপ্রেরণাস্থল হতে পারেননি। তদুপরি পরবর্তী ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নেতা হিসেবে তারেক রহমানকে ক্লিন-ইমেজে ও সঠিকভাবে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করার কাজটি করা সম্ভব হয়নি। ইমেজ সংকট ও মামলার জালে তারেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যত আক্রান্ত। শারীরীকভাবেও ১/১১-এর সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বহুমুখী আঘাত ও আক্রমণ ঠেলে রাজনীতির মাঠের বিরূপ পরিস্থিতিকে হটিয়ে নিজের জায়গা করে নেওয়া তারেক রহমানের সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। যেহেতু একটি রাজনৈতিক দলের জন্য দলটির আদর্শ-উদ্দেশ এবং মূল নেতৃত্বই প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে, সেহেতু বিএনপির পুনরুজ্জীবনের জন্য এসব প্রসঙ্গ অতীব জরুরি বিষয়রূপেই বিশেষজ্ঞরা বিবেচনা করছেন। প্রকাশ্যে না হলেও চাপাস্বরে অনেকেই জানতে চাইছেন, ‘খালেদা জিয়ার পর কে?’
একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষমতায় বা ক্ষমতার বাইরে থেকে নিজস্ব নীতি-আদর্শ-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ইত্যাদি ব্যাপক কর্মী-সমর্থক-জনগণের মধ্যে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ করে যেতে হয়। রাজনৈতিক দল হিসাবে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সকলের সামনে স্পষ্ট থাকতে হয় এবং সে লক্ষ্যে দলটির পরিষ্কার অবস্থান ও কার্যক্রম থাকতে হয়। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শভিত্তিক কাজকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আপোসহীন ও দ্বিধাহীনভাবে পরিচ্ছন্ন অবস্থান ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিএনপি সে তুলনায় লক্ষ্য ও আদর্শের জায়গাটিকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিতে পারছে না। জিয়ার ১৯ দফা দলের নেতা-কর্মীদের কাছে বা জনগণের সামনে তুলে ধরার কাজ বলতে গেলে বন্ধই আছে। বরং নানা ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন-সংগ্রামের চক্করে বিএনপি ঘুরপাক খাচ্ছে। ১৯ দফার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে; ভবিষ্যতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও কী কী করতে হবে, সেটা দলের পক্ষ থেকে জনগণের সামনে আকর্ষণীয় ও আশাব্যঞ্জকভাবে তুলে ধরা হয়নি।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ডানের বাম আর বামের ডান অর্থাৎ ডানপন্থীদের মধ্যে যারা উদার আর বামপন্থীদের মধ্যে যারা কম বিপ্লববাদী, তেমন লোকদের টেনে এনে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারায় সম্পৃক্ত ও প্রশিক্ষিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে বিএনপি তার জনশক্তি ও কর্মী-সমর্থক বাহিনীকে দলের আদর্শিক মোটিভেশনের আওতায় ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি গুরুত্বের সঙ্গে করেনি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও অঞ্চলভিত্তিক স্বার্থবাদী কোটারি গড়ে ওঠেছে দলের সর্বস্তরে। ফলে দলে নানা মতের ও চিন্তার মানুষ একটি অভিন্ন দলীয় লক্ষ্য ও আদর্শের জায়গায় সমবেত হয়ে মিলিতভাবে কাজ করতে পারছে না। রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপি হয়ে গেছে ভঙ্গুর। আদর্শ ও নেতৃত্ব হয়েছে দ্বিধাগ্রস্ত ও স্থবির।
পরিসংখ্যানগত দিক থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এ দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই দল প্রতিষ্ঠা করে ৩০ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে তার শাসনকে বেসামরিক করার উদ্দেশ্য ১৯ দফা কর্মসূচি শুরু করেন। তিনি সফলভাবে সামরিক ক্ষমতাকে বেসামরিক ক্ষমতায় পরিণত করেন এবং নিজস্ব জনপ্রিয়তার বলয় গড়ে তুলেন।
জিয়ার পরে খালেদা জিয়া দলের হাল ধরে হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু পরবর্তী নেতারূপে তারেক রহমানের অভিষেক বাধাহীন ছিল না। নানা বিতর্ক ও সমালোচনায় তাকে বিদ্ধ করা হয়। এক পর্যায়ে বিরোধীরা তারেক ইস্যুকে তীব্রভাবে প্রচার করে। তারেক রহমান সকল আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। বিএনপি সে সময় তাদের দলের ভবিষ্যৎ নেতার ইমেজ রক্ষায় সম্মিলিতভাবে বিরোধী আক্রমণ মোকাবেলা করার কাজ করতে পারেনি। বহু সিনিয়র নেতাকে বরং আড়ালে-আবডালে তারেক রহমানের নিন্দা-মন্দ ও কুৎসা করতে শোনা যায়। অথচ তারাই সামনা-সামনি তারেক রহমানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কেউ কেউ খালেদা ও তারেকের মধ্যে সুক্ষ্ম দূরত্ব সৃষ্টিতেও অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন। ফলে সাধারণের মধ্যে বিএনপি এবং হাওয়া ভবন নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। বিএনপির নেতৃত্বের জায়গাটি একক ও ঐক্যবদ্ধ বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছে, দ্বৈত শাসন চলছে। স্তাবক, চাটুকার ও বন্ধুবেশী শত্রুরা প্রকাশ্যে প্রশংসা আর গোপনে নিন্দার মাধ্যমে তারেক রহমানের রাজনৈতিক অভিষেককে বিতর্কিত করে ফেলে। বিরোধী পক্ষ সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি তীব্র তারেক বিরোধী পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এবং নানা মামলা ও অভিযোগে তাকে জর্জরিত করে ফেলে।
এমতাবস্থায় তারেকের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ও পুনরুজ্জীবন কঠিন বাধার সম্মুখীন। উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতিতে রক্ত ও বংশীয় নেতৃত্বের প্রাধান্যের যে ধারা চলছে, তাতে হাসিনা-রেহানা-জয় কিংবা সোনিয়া-রাহুল-প্রিয়াঙ্কার প্রাধান্য একটি ওপেন সিক্রেট। কিন্তু বিএনপির ক্ষেত্রে তারেকের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণের কাজটি শুরুতেই যেভাবে বিতর্কিত এবং পরবর্তীতে মামলা-মোকাদ্দমায় আকীর্ণ করা হয়েছে, তাতে বিএনপির এই তরুণ ও ভবিষ্যৎ নেতার রাজনৈতিক গতিপথ ও উত্থান কঠিন করে দেওয়া হয়েছে। আর এ কথাও সত্য যে, খালেদা জিয়ার পর জিয়া-খালেদার উত্তরসূরী হিসেবে পারিবারিক ঐতিহ্যে কেউ এগিয়ে এসে দলের কাণ্ডারির ভূমিকা পালন না করলে বিএনপির সংহতি, ঐক্য ও গতি ব্যাহত হবে। অতএব দলের আদর্শিক ও নেতৃত্বের জায়গাটি দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির শক্তি ও অবস্থানও ধীরে ধীরে লয় প্রাপ্ত হবে।
শুধু ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকাই একটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান কাজ হলেও সেটাকে আদর্শিক নেতৃত্বের ভিত্তিতে করা না-হলে সে ক্ষমতা টেকসই ও দৃঢ় হয় না। বিএনপি ১/১১-এর পর ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করছে বটে; কিন্তু সেটা দলের আদর্শের ভিত্তিতে জনসমর্থন তৈরি ও নিজস্ব নেতৃত্বের ভিত্তিতে করতে পারছে না। ক্ষমতাকালীন অতীত ভুলকে চিহ্নিত ও সে ভুলের শিক্ষায় নতুন কর্মপন্থাও নিতে পারছে না। বিপুল জনসমর্থন নিয়েও নিঃসঙ্গ খালেদা জিয়ার বিএনপি যেন রয়েছে আদর্শ ও নেতৃত্বগত কাণ্ডারিহীন-উদভ্রান্ত অবস্থায়। অবিশ্বস্ত ও সুবিধাবাদীদের ভিড়ে বিএনপি একটি বিশৃঙ্খল কাঠামোর মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। দল কে চালাচ্ছে? কমিটি ও বিভিন্ন পদ-পদবি কে বণ্টন করছেন? কিসের ভিত্তিতে বিতর্কিতদের পক্ষে দলে জায়গা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না।
আগে যেমন সকল কিছুর জন্য তারেক ও হাওয়া ভবনের ওপর দোষ চাপানো হতো, এখনও কোনো কিছু হলেই লন্ডনের দিকে আঙুল তোলা হয়। ফলে দ্বিধা, স্থবিরতা ও বিষোদগারের ধারা যেন বিএনপির পিছু ছাড়তেই চাইছে না। যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে বিগত আন্দোলনের সময়। ‘মার্চ ফর ডেমেক্রেসি’র ডাক দিয়ে খালেদা জিয়া নিঃসঙ্গ হয়ে যান। দলের নেতা-কর্মীরা তার ডাকে সাড়া দেন নি। এমনকি প্রায়-গৃহবন্দী নেত্রীকে উদ্ধারেও কেউ এগিয়ে আসেননি। বড় বড় কথা বলা নেতারা গ্রেফতার এড়িয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিলেন। এই ধরনের নেতাদের সাধারণ কর্মীরাও বিশ্বাস করে না। বিপদের বন্ধু মনে করে না। এদের দ্বারা কর্মী-সমর্থক বা জনগণকে সংগঠিত করা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিধা-স্থবিরতা-সুবিধাবাদে আক্রান্তরা থমকে দিয়েছে বিএনপির গতি ও কার্যক্রম।
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময়০৯:৪৫ এ.এম, ২৫ এপ্রিল ২০১৭,মঙ্গলবার
ইব্রাহীম জুয়েল