সীমান্ত হত্যা বেড়ে যাওয়া, তিস্তা চুক্তি ঝুলে থাকা—সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রধান উদ্বেগ ছিল এই দুটি। এরই মধ্যে ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি) নিয়ে দেশটিতে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে দিল্লির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সীমান্তের এপারে কী প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে প্রথমবারের মতো গতকাল সোমবার ঢাকায় এসে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আশ্বাস দিয়েছেন, সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কিছু নেই। আর দিল্লির বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে করে ভারত সরকার। দিল্লির সহিংসতায় তৃতীয় পক্ষের মদদ আছে কি না, সেটা ভারত খতিয়ে দেখছে। এ ব্যাপারে তথ্য পেলে বাংলাদেশকে তা বিনিময়ের আশ্বাস দিয়েছে ভারত।
মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে (১৭ মার্চ) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর চূড়ান্ত করতে দুই দিনের সফরে গতকাল ঢাকায় এসেছেন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। এর পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও আস্থা আরও বাড়ানো নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে তাঁর দপ্তরে বৈঠক করেন তিনি।
গতকাল বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের পররাষ্ট্রসচিবে পর্যায়ের বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। এর আগে দুপুরে সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন তিনি। সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।
দুই পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, মূলত বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সময় প্রাসঙ্গিকভাবে ভারতের বিশেষ করে দিল্লির সাম্প্রতিক পরিস্থিতিও আলোচনায় এসেছে। তিনি জানান, যেহেতু ভারতের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আসছেন, এই ফাঁকে ১৮ মার্চ দুই প্রধানমন্ত্রীর একটি বৈঠক আয়োজনেরও প্রস্তুতি চলছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের সময় কোন কোন সমঝোতা স্মারক সই করা যায়, সে বিষয় নিয়েও কথা হয়েছে। ওই বৈঠকের পর একটি যৌথ ইশতেহার প্রচারের বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষই বিবেচনা করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর যৌথ ইশতেহার প্রচারিত হলে সেটিতে মুজিব বর্ষকে কেন্দ্রে রেখে ভবিষ্যতের সম্পর্ক কোন পথে যাত্রা করবে, তার প্রতিফলন থাকবে।
দুই পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই, সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি পূরণের পাশাপাশি বাংলাদেশ সিএএকে ঘিরে ভারতের রাজধানী দিল্লির পরিস্থিতি আলোচনায় তুলেছে।
প্রতিহতের ঘোষণায় ‘বিব্রত নই’
সচিবালয়ে দুপুরে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আসা প্রতিহতের ঘোষণায় সরকার মোটেও বিব্রত নয়।
ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের একটি পক্ষ নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর প্রতিহত করার যে ঘোষণা দিয়েছে, তাতে সরকার বিব্রত কি না জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা মোটেও বিব্রত না। আমরা মনে করি, এটা যারা করছে তাদের এটা করা মোটেও উচিত হচ্ছে না। মুজিব বর্ষকে সামনে রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে স্বাগত জানানো উচিত।’
নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে কী নিয়ে আলোচনা হতে পারে জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে যখন আলোচনা হবে, তখন সব বিষয়ে আলোচনা হবে।’
এ সময় হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেন, ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) কোনো প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বে না। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এখন আগের চেয়ে আরও ভালো বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বন্ধুত্বের সময়ে হত্যা দুর্ভাগ্যজনক
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিকেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। পরে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমাদের সীমান্তে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ বছর হত্যাকাণ্ড অনেক বেড়ে গেছে, এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। আমি বললাম, আপনারা আমাদের বন্ধু মানুষ। এই বন্ধুদের মধ্যে হত্যাকাণ্ড হওয়া ঠিক না।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন।
তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে কিছু অসুবিধার কথা জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব। বিষয়টি ভবিষ্যতে সুরাহা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে কী কথা হয়েছে, তা জানিয়ে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমরা গণতান্ত্রিক কাঠামোয় নির্বাচিত সরকার এবং জনগণের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। মানুষ এ নিয়ে আমাদের প্রশ্ন করে। এ ক্ষেত্রে (তিস্তা চুক্তি) আমাদের বন্ধুত্বে কাজ হচ্ছে না। তিনি (ভারতের পররাষ্ট্রসচিব) বললেন, তাঁরা বিষয়টি দেখছেন।’
ভারতে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে চলমান সহিংসতার বিষয়টি আলোচনায় তোলার কথা জানিয়ে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘তোমাদের দেশের (ভারতের) অনেক প্রসঙ্গ আছে, যেগুলো আমাদের দেশে সময়ে সময়ে চিন্তার কারণ হয়। উদ্বেগ আমাদের জনগণও করে এবং সে জন্য জনগণের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। সেসব সম্পর্কে আমরা চাই তোমরা এমন কোনো কাজ করবা না, যাতে আমাদের অসুবিধার সৃষ্টি হয়।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ
এদিকে বাসস জানায়, গণভবনে গতকাল বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রীংলা। সাক্ষাৎ শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় এবং উপ-আঞ্চলিক সংযোগ (কানেকটিভিটি) নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তাঁর শুভেচ্ছা পৌঁছে দিতে বলেন।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশের আর্থসামাজিক সূচকগুলোর উন্নয়ন বিশেষ করে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস থেকে নারীশিক্ষা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে সাক্ষরতায় চমকপ্রদ সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উন্নয়নেরও প্রশংসা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন, ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুহম্মদ ইমরান এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাস এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা ব্যুরো চীফ,৩ মার্চ ২০২০