দিনের বেলায় সব ‘এক’। রাত ঘনিয়ে এলেই ‘এক’ হওয়া নেতারাই ভাগ ভাগ হয়ে প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেন। এ পরিস্থিতির মধ্যে থেকেই কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপিকে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এ নির্বাচনে তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকবিলা করতে হবে। প্রথমত, গত ডিসেম্বরে নারায়ণগঞ্জের মতো ‘মডেল’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। দ্বিতীয়ত, ২০১২ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের কৌশলী প্রতিশোধ। আর তৃতীয়ত, কুমিল্লায় দলীয় বলয়ে শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য আনা।
অন্যদিকে নীরব কোন্দলে বেকায়দায় আছে বিএনপিও। দলীয় প্রার্থীকে নির্বাচন জয়ী হতে হলে দলের এই কোন্দলের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে। আর আছে মেয়র পদ ধরে রাখার মতো মর্যাদার পরীক্ষা।
গতকাল মঙ্গলবার নগরী ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে। গতকাল রাত ১২টার পর প্রচার বন্ধ হয়ে যাবে, যা শুরু হয়েছিল গত ১৫ মার্চ। শেষ দিনে প্রচারের চেয়ে প্রতিপক্ষের কোন্দলের সুযোগ নিয়ে কৌশলের খেলা শুরু হয়েছে দুই দলেই।
সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলীয়ভাবে নির্বাচন হচ্ছে। এবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন আঞ্জুম সুলতানা সীমা।
তিনি দলের জেলা কমিটির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আফজল খানের মেয়ে। সীমাও জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু দলের জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি নগর সংস্থার প্রথম নির্বাচনে আফজল খানকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা স্থানীয় এক সংসদ সদস্য ও ২০ দলীয় জোটের মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে নগরীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রচারে বাধা সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
জানা গেছে, ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হলেও দলে তখন তিনি স্থানীয় কোনো কমিটির সদস্যও ছিলেন না। কুমিল্লা-৬ (সদর) আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য হন। পর পর দুইবার দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত হওয়ার পরও দলের কোনো কমিটিতে পদ পাননি তিনি। তবে নগরীর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বাহারের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে।
অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাধারণ সম্পাদক রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক। দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মন্ত্রী হওয়ার পরও এ দুই নেতার অনুসারীদের পাত্তা দেন না বাহার। আফজল খানের সঙ্গে বাহারের বিরোধের বিষয়টি এখনো নগরবাসীর আলোচনায় স্থান পায়।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতে, এ অবস্থায় কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ভারসাম্য আনতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী করা হয়েছে আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে।
দলীয় প্রার্থীকে ‘জয়ের মালা’ পরিয়ে আওয়ামী লীগ কুমিল্লায় আগামী দিনের রাজনীতির পথ মসৃণ করতে চায়। এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় নির্বাচনী প্রচারের মাঠে নামতে হয়েছে সংসদ সদস্য বাহারের মেয়ে তাহসিন বাহার সূচিকে। তাঁর বাড়িতে দলীয় প্রার্থীর উঠান বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কোন্দলের অস্বস্তি রয়ে গেছে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নির্বাচন সমন্বয়কারী দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘কুমিল্লা আওয়ামী লীগে বাহার-আফজলের কোন্দল পুরনো। ১৫ দিন কুমিল্লায় থেকে আজ চলে যাচ্ছি। তবে নৌকার পক্ষে তেমন জোরালোভাবে কাজ করার প্রমাণ পাইনি। এটা হয়তো বিভক্তির কারণে হতে পারে। এমন কৌশল করা হয়েছে যে মনে হচ্ছে পুরো পরিস্থিতি বিএনপির পক্ষে রয়েছে। ’
তিনি বলেন, আজ (গতকাল) ২১ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচনী প্রচারে বাধা দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেটরা। ৭৫ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা (প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার) আনা হয়েছে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। এখানে শিবিরের সভাপতিও রয়েছেন। একজন ‘মোস্ট পাওয়ারফুল এমপি’ ও সদ্য সাবেক মেয়র নেপথ্যে থেকে এসব করছেন। তাঁরা সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেছি। ’
নির্বাচনে দলীয় কোন্দলের প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সীমা বলেন, ‘কোন্দল একটু-আধটু সব জায়গায় আছে—কোথায় নেই? প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা আমাকে প্রার্থী ঘোষণা করার পর থেকে কুমিল্লা আওয়ামী লীগে কোন্দল নেই। সবাই আমার জয়ের জন্য এবার প্রচারে অংশ নিয়েছেন। প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ দেখিনি। তবে কার ভেতরে কী আছে তা আল্লাহই বলতে পারে। ’
২০ দলীয় জোট মনোনীত বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুকেও নীরব দলীয় কোন্দলের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা ও অধুনালুপ্ত কুমিল্লা-৯ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুরোধে তাঁর পক্ষে প্রচারে অংশ নিতে কুমিল্লায় এসেছিলেন। এত দিন ভেতরের ক্ষোভ গোপন করে কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি সাক্কুর প্রচার থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। গত রবিবার তিনি ঢাকায় ফিরে গেছেন।
মনিরুল হক চৌধুরীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি রয়েছে নগরীর ১৯ থেকে ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে। সদ্য সাবেক চারজন কাউন্সিলর তাঁর সমর্থক। মনিরুল হক চৌধুরী চলে যাওয়ার পর স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতা আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে ‘গোপনে’ তৎপরতা শুরু করেছেন। গতকাল ২২ নম্বর ওয়ার্ডের একাধিক ভোটার জানান, বিএনপির সাক্কুবিরোধীরা তাঁদের ভোট না দিতে অনুরোধ করেছেন। এবার পরিবর্তন দরকার বলে তাঁরা এই অনুরোধ জানান।
এ ছাড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমিন উর রশীদ ইয়াছিনের সঙ্গেও সাক্কুর দূরত্ব রয়েছে। ইয়াছিন সাধারণ সম্পাদক আর তাঁকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করার বিষয়টি সাক্কু মেনে নিতে পারেননি। দুই বছর আগে ইয়াছিন-সাক্কু প্রকাশ্যে এক হলেও ভেতরে ভেতরে তাঁদের গোপন দূরত্ব রয়ে গেছে।
তবে বিএনপির মেয়র প্রার্থী সাক্কু বলেন, ‘আমার পক্ষে দলের সবাই এক হয়ে কাজ করছেন। ’
চোখে পড়েনি প্রচারের কোলাহল :
বুধবার সকালে নগরের রানীর বাজার হয়ে যেতে যেতে বিভিন্ন স্থানে চোখে পড়ল দড়ির ওপর টানানো সাদাকালো পোস্টার। বাতাস পেয়ে ছন্দে ছন্দে দুলছিল সেগুলো। কোথাও পোস্টার সাঁটানো হয়েছে দেয়ালে, গাড়ির পেছনে। প্রার্থী, সমর্থক, ভোটারদের বাঁধভাঙা কোলাহল, মুখরতা কোথাও ছিল না। আরো দশটা দিনের মতোই ছিল নাগরিক জীবনযাপনের স্বাভাবিকতা। দুপুর ২টার পর থেকে প্রচার শুরু হলেও অন্যান্য দিনের মতো চাঞ্চল্য ছিল না। নগরীর রানীর দীঘির পাড়ে পথে চলতে চলতেই ভোটার সুলতানা সিরাজ বললেন, ‘আজ সব থমথমে। ’ তাঁর মতে, ভিন্নমাত্রা যোগ করতে পারত নির্বাচনের উৎসব।
কান্দিরপাড়, রানীর দীঘির পাড়, মুন্সেফবাড়ি, ঠাকুরপাড়া, টমসন ব্রিজ—কোথাও তেমন উৎসবময়তা দেখা গেল না।
দুই প্রার্থীরই জয়ের আশা :
আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা দুপুরে নগরীর গোবিন্দপুর থেকে অশোকতলায় গণসংযোগের জন্য যাচ্ছিলেন। বললেন, ‘আজ জনসভা করব না। গণসংযোগের মধ্য দিয়েই শেষ করব প্রচার। ’
জয়ের ব্যাপারে কতটা আশাবাদী জানতে চাইলে সীমা বললেন, ‘আমি শতভাগ আশাবাদী। ২০১২ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের প্রতীক ছিল না। এবারের নৌকা প্রতীক নিয়ে ঘরে ঘরে গেছি। উন্নয়নের জন্য নৌকার দরকার। ’
‘সাক্কু আপনার বাবাকে হারিয়েছিলেন, আপনার লড়াইয়ের প্রস্তুতি কেমন, জানতে চাইলে সীমা বলেন, ‘নৌকার শক্তি অনেক। এ ছাড়া মুজিব চাচা, কামাল চাচা, তাঁদের পরিবারের সদস্যরা আমার সঙ্গে আছেন। তবে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষ থেকে কালো টাকা ছড়ানো হচ্ছে। এতে ভয় হচ্ছে। ’
নানুয়া দীঘির পাড়ে ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর বাসায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। অধুনালুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভার পরপর দুবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি দলের সমর্থন ও প্রতীক ছাড়াই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আফজল খানকে প্রায় ৩০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে হয়েছিলেন প্রথম মেয়র।
সাক্কু বললেন, ‘২০১২ সালের নির্বাচনে ইভিএম থাকায় এবং সেনাবাহিনী না থাকায় এখানে বিএনপি ছিল না। এবার বিএনপির সমর্থন আর ধানের শীষ প্রতীক আছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি জিতব। ’ তিনি অভিযোগ করেন, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক আওয়ামী লীগের প্রার্থী সীমার পক্ষে ভোট চেয়েছেন। গত ২৬ মার্চ রেলমন্ত্রী হোটেল হাইওয়ে ইন এবং পরিকল্পনামন্ত্রী বেলতলিতে এই ভোট চান। সাক্কু বলেন, ‘রেলমন্ত্রী ২৭ নম্বর ও পরিকল্পনামন্ত্রী ২২, ২৩ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে নৌকার জয় নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়েছেন বলে জানতে পেরেছি। মন্ত্রীদের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন হলে আমার জয় হবে। ’
সাক্কু আরো বলেন, ‘আমার পোস্টার ছেঁড়া, প্রচারযন্ত্র ভাঙাসহ বিভিন্ন অভিযোগে নির্বাচন কমিশনে ১৫-২০টি অভিযোগ দিয়েছি। ’
তবে পরিকল্পনামন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিএনপির দলীয় মেয়র প্রার্থীর অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচন সমন্বয়কারী কাজী জাফর উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে তারা অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। পরিকল্পনামন্ত্রী ঢাকায় আছেন। রেলমন্ত্রীও কুমিল্লা শহরে নেই। ’
সীমাকে জাপার সমর্থন : আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে সমর্থন জানিয়েছে জাতীয় পার্টি (এরশাদ)।
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, কুমিল্লা জানান, বুধবার বিকেলে শহরতলির একটি রেস্তোরাঁয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের এ সমর্থনের কথা জানান জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম ফয়সাল চিশতী।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা শাখার সভাপতি সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মিলন, দলের চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা সংসদ সদস্য বেগম রওশন আরা মান্নান ও ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নুরু, কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সহসভাপতি কুমিল্লা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক মো. ওমর ফারুক। (কালেরকণ্ঠ)
নিউজ ডেস্ক
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০১: ০০ এএম, ২৯ মার্চ ২০১৭, বুধবার
ডিএইচ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur