Home / চাঁদপুর / দশ দিনেও উদঘাটন হয়নি রুবেল মৃত্যুর রহস্য
উদঘাটন

দশ দিনেও উদঘাটন হয়নি রুবেল মৃত্যুর রহস্য

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন : চাঁদপুর জেলা মতলব উত্তর উপজেলা ছেংগারচর পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ড আদুরঘাটি গ্রামের মৃত হাবুল সরদারের ছেলে রুবেল সরদার। আকাশছোঁয়া স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যার বিমানে ওঠার কথা ছিল ১১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার। ২৭ বছর বয়সী সদা হাস্যজ্জল সেই রুবেল হাসান রাফি আজ প্রবাস জীবনের পরিবর্তে ঘুমিয়ে আছে পরোপারের জীবনে। গত ২ ফেব্রুয়ারি তার জীবন প্রদীপ নিভে যায় রহস্যময় মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে।

দশ দিন পেরিয়ে গেলেও রাফির মৃত্যু নিয়ে কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি চাঁদপুর জেলা পুলিশ, এমনটাই দাবি নিহতের পরিবারের। তারা বলছেন কোন এক অদৃশ্য শক্তি বা প্রভাবশালী মহলের ইশারায়, একে একে দশ দিন পেরিয়ে গেলেও গ্রেপ্তার করা হয়নি কাউকে।’

পরিবারের অভিযোগ, ‘সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য ও আলামত পুলিশের কাছে উপস্থাপন করা হলেও এ ব্যাপারে পুলিশ তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তাদের দাবি এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড, কিন্তু পুলিশ এটিকে অপমৃত্যু হিসেবে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে। আর তাই প্রকৃত ঘটনার রহস্য উদঘাটনে জেলা পুলিশের প্রতি আস্থা হারাতে বসেছে নিহত রাফির পরিবার।’

তবে পুলিশ বলছে ভিন্ন কথা। নিহতের পরিবারকে আশ্বস্ত করে পুলিশ জানায়, এটি হত্যা না আত্মহত্যা তার রহস্য উদঘাটনে তদন্ত চলমান রয়েছে। খুব দ্রুত সময়ে এর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করা হবে।

এদিকে নিহত রাফির পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঔষধ কোম্পানিতে কর্মরত রাফি ১ ফেব্রুয়ারি তার নিজ বাড়ি মতলব থেকে কর্মস্থল নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ছিল। ঐদিন নোয়াখালী না গিয়ে চাঁদপুর শহরের বিপনীবাগ এলাকায় নিউ হোটেল রূপসী নামের একটি আবাসিক হোটেলে অজ্ঞাত এক বন্ধুর সাথে রাত্রি যাপন করে। হোটেল ম্যানেজার আবুল হোসাইন জানায়, রাফির সাথে রাত্রি যাপন করা তার ওই অজ্ঞাত বন্ধু দুই ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার দিকে হোটেল ত্যাগ করে। দীর্ঘ সময় পর দুপুরের দিকে হোটেলের নিয়মিত চেক আউট তল্লাশিকালে স্টাফদের নজরে আসে ৯ নম্বর কক্ষে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে থাকা রাফির দেহ। বিষয়টি হোটেল কর্তৃপক্ষ তৎক্ষণাৎ চাঁদপুর মডেল থানা পুলিশকে জানায়।

নিহত ও অজ্ঞাত উভয় ব্যক্তির সঠিক পরিচয় নিশ্চিত করতে নিয়ম অনুযায়ী তাদের আইডি কার্ড এবং ছবি হোটেলের সংরক্ষণ থাকার কথা থাকলেও কেন তা নেই? এমন প্রশ্নে হোটেল ম্যানেজার জানান, নিহত রাফির সাথে থাকা ঐ অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছে আইডি কার্ড চাইলে তিনি প্রবাসে থাকেন বলে জানান, এ সময় পাসপোর্ট চাওয়া হলে বলেন, যেহেতু মাছ কেনার জন্য এসেছি তাই পাসপোর্ট সাথে নিয়ে আসিনি।’ তাই তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী নাম ঠিকানা এন্ট্রি করা হয়। এদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আওলাদ জানান, ‘আমি তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে ময়না তদন্তে ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছি যে, ভিকটিমকে কেউ হত্যা করেছে কিনা বা ঝুলন্ত থাকা অবস্থায় আগে তাকে কেউ বিষ জাতীয় কোন খাবার খাইয়েছে কিনা।’

পুলিশের এই তদন্ত কর্মকর্তা আরো জানান, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়ার পর মূল তথ্য জানা যাবে। মামলা তদন্তাধিন আছে, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে এ সংক্রান্ত বিষয়ে কোন অপরাধ ঘটে থাকে, তাহলে তা সঠিকভাবে উদঘাটন করার জন্য।

এ বিষয়ে চাঁদপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাহার মিয়া জানান, খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে লাশের সুরতহাল করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। পুলিশ হোটেল এবং আশপাশের সিসি ক্যামেরাগুলো যাচাই শেষে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে।’

এটি আত্মহত্যা নাকি পরিকল্পিত কোন হত্যাকান্ড? এমন প্রশ্নে পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিক তদন্তে এটি আত্মহত্যা বলে প্রতিয়মান হওয়ায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে ঘটনার আগের দিন ভিকটিমের সাথে তার এক বন্ধু হোটেলে থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় কেউ জড়িত আছে কিনা আমরা তা খতিয়ে দেখছি। ভিকটিম এবং তার ঐ বন্ধুর মোবাইল এখনো নিখোঁজ রয়েছে। আমরা ঘটনার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। ঘটনার কোন তথ্য ও সূত্র পেলে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট প্রাপ্তি সাপেক্ষে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তবে রাফির পরিবারসূত্রে ও প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জানা যায়, মৃতদেহ উদ্ধারের আগের দিন ১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাফি ও তার অজ্ঞাত বন্ধু শহরের ইলিশ চত্বর এলাকার আবরার হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে। খাওয়া শেষে তারা একটি পার্সেল সাথে নেয় বলে সূত্র জানায়। পুলিশ এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালালে বেরিয়ে আসতে পারে নতুন কোন চাঞ্চল্যকর রহস্য। এমন দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।

একইদিন সন্ধ্যায় আবরার হোটেলে নিহত রাফি ও তার অজ্ঞাত বন্ধুর সাথে মতলব দক্ষিণের বাসিন্দা শামীম নামের এক যুবকের দেখা হয়। শামীম জানায় ২০১৩ ব্যাচের অনলাইন প্লাটফর্মের সূত্র ধরে তাদের পরিচয়। ঐদিন শামীম তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চাঁদপুর শহরের বড় স্টেশন এবং তারুণ্যের মেলায় ঘোরাঘুরি শেষে আবরার হোটেলে যায়। সেখানে নিহত রুবেল হাসান রাফি ও তার অজ্ঞাত বন্ধুর সাথে দেখা হয়। তবে শামীম জানায়, রাফির সঙ্গে থাকা তাঁর ঐ অজ্ঞাত বন্ধুকে আমি চিনতে পারি নাই এবং ইতিপূর্বে আর কখনোই তাকে দেখি নাই। স্বাভাবিকভাবে তার সাথে কথা শেষে আমার পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যাই। পরদিন যখন শুনতে পাই যে, রাফি আর বেঁচে নেই। বিষয়টি শুনে আমি হতবাক হয়ে যাই। এ ঘটনায় আমাদের ২০১৩-এর ওই ব্যাচের অনেকেই ঘটনার সত্যতা জানার জন্য ছুটে আসি।

রাফির মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে চলমান তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে নিহতের ভাই চান মিয়া বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যার ঘটনায় আসামি ধরার কোন তৎপরতা দেখছি না। আমি খবর পেয়ে বিদেশ থেকে চলে এসেছি এবং পুলিশের সাথে দুবার দেখা করেছি। পুলিশের সাথে কথা বলার পরিপেক্ষিতে আমরা যা বুঝতে পারলাম, মামলাটাকে অপমৃত্যু দেখানো হচ্ছে, যা কখনোই হতে পারে না। আমার ভাই যে হোটেলে খাইলো সেখানে আসামি সনাক্ত করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও এখনো আসামি ধরার কোন প্রক্রিয়া বা অগ্রগতি আমরা দেখছি না।

এ সময় চান মিয়া আরো বলেন, ওখানে যে খাবারটা খাইলো, খাওয়া শেষে যে পার্সেলটা নিলো, তা কার জন্য নিয়েছিল?

মামলার রহস্য উদঘাটনে চান মিয়া বলেন, আমি দ্রুত এ মামলার রহস্য উদঘাটন দেখতে চাই। আমার ধারণা এ মামলা পিবিআই তদন্ত করলে আমি সুষ্ঠু বিচার পাব এ আশা করছি।’

চান মিয়ার এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে চাঁদপুরের পুলিশ সুপার মোঃ আব্দুর রকিব (পিপিএম) দৃঢ়তার সাথে নিহতের পরিবারকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘মামলার রহস্য উদঘাটনে পুলিশ তৎপর রয়েছে। আমরা হোটেল এবং আশপাশের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। আমরা জানতে পেরেছি নিহতের সাথে তার অজ্ঞাত এক বন্ধু ছিল, আমরা তার পরিচয় সনাক্ত করার চেষ্টা করছি। তার পরিবারের দাবি রয়েছে এটি হত্যাকাণ্ড হতে পারে, এ বিষয়েও আমরা তদন্ত করছি। পুলিশের এই কর্মকর্তা আরো জানান, অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে এ ধরনের মৃত্যুকে ঘিরে, তবে কোন ধরনের প্রভাব এখানে কাজ করবে না। আমরা মৃত রুবেলের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

পরিবারের পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট রুবেল হাসান রাফি মালয়েশিয়া যাওয়ার যে ফ্লাইট ধরার অপেক্ষায় ছিল, বিমান টিকিট তারই সাক্ষ্য বহন করে। পরিবারসহ সবার প্রত্যাশা রাফির রহস্যজনক এই মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য যেন উদঘাটন হয়।

প্রতিবেদক: মুসাদ্দেক আল আকিব, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫