রাজনীতি

দলের ভেতরে-বাইরে হতাশার বিষবাষ্প

১৯৭৮ সালে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ঘোরতর রাজনৈতিক সঙ্কটে ক্ষমতার বৃত্তে সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে চার দশক পূর্ণ করতে চলেছে।

দীর্ঘ পথচলায় বিএনপি কয়েক দফায় ক্ষমতায় ছিল প্রায় ১২ বছর। প্রথম বার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ১০ বছর পর আবার দেখা পায় সিংহাসনের। মাঝে আবার এক মেয়াদে বাইরে থেকে ফিরে আসে ক্ষমতায়।

এখন ক্ষমতা থেকে ছিটকে প্রায় এক যুগ সময় কাটছে দলটির। আবার ক্ষমতায় আসা কিংবা অর্থবহ প্রধান বিরোধী দল হিসাবে কার্যকর থাকার চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে চলছে বিএনপির দিনকাল।

সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা, পরনির্ভরশীলতা, কোন্দল, নীতি ও কৌশলগত সীমাবদ্ধতাসহ নানাবিধ কারণে বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে নাজুক সময় পার করছে। সর্বত্র প্রশ্ন, বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বিএনপি কি আবার ক্ষমতায় আসতে পারবে? নাকি আরো কোণঠাসাই হতে থাকবে?

বিএনপির অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত নিয়ে দলের ভেতরের ও বাইরের নেতা-কর্মী, বিশেষজ্ঞসহ নানা মহলের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া যায় নি পরিস্কার কোনো ধারণা। বরং দেখা গেছে, দলের ভেতরে-বাইরে-চারপাশে বইছে হতাশার বিষবাষ্প।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের প্রয়োজনে বিএনপি ক্ষমতায় থেকে কিংবা ক্ষমতার বাইরে কিরূপ ভূমিকা পালন করেছে, তা একটি জরুরি প্রসঙ্গ। কারণ সামরিক ক্ষমতার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভকারী বিএনপি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শতভাগ সাফল্য দেখাতে পারে নি।

দীর্ঘ সামরিক স্বৈরশাসনের কবল থেকে দেশকে সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রায় আনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলাদাভাবে নেতৃত্ব দেওয়া বিএনপির সরকারি ক্ষমতাচর্চার ইতিহাস গণতান্ত্রিক নয়।

ব্যক্তি ও পরিবারের প্রাধান্যে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারাকে ম্লান করেছে বিএনপি। বর্তমানে বাংলাদেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থে বিএনপির ইতিবাচক ভূমিকা সকলের কাছে প্রত্যাশিত হলেও হতাশা, সিদ্ধান্তহীনতা ও দিকভ্রান্তি দলটিকে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে।

বিএনপির ইতিহাসে ব্যর্থতার চিহ্নও কম নয়। দুই দুই বার বিএনপি জনগণের অধিকারকে সাংগঠনিকভাবে রক্ষায় শোচনীয়ভাবে অসফল হয়েছে। জনগণ ভোটের মাধ্যমে যে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা বিএনপিকে দেশ পরিচালনার জন্য দিয়েছিল, সেটা রক্ষা করতে পারেনি বিএনপি।

একবার ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় সামরিক শাসক এরশাদ। আরেকবার সেনা-সমর্থিত মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনরা। এরশাদ ছিলেন জিয়ার দ্বারা উপকৃত।

আর মইনউদ্দীন-মাসুদউদ্দিন-ফখরুদ্দীনরা খালেদা জিয়ার মাধ্যমে সুবিধাপ্রাপ্ত। আঞ্চলিক ও আত্মীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে এমন ব্যক্তিদের বিএনপি সুযোগ দিয়েছিল, যারা বিএনপিই বারোটা বাজায় নি; বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকেও বিচ্যুত করেছিল।

দল হিসাবে দেশের গণতান্ত্রিক স্বার্থ রক্ষায় বিএনপির ব্যর্থতা সহজেই দূর হওয়ার নয়। স্বার্থচিন্তা, আদর্শিক রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব এবং সাংগঠনিক দূর্বলতা বিএনপিকে বার বার ক্ষমতায় থাকার পরেও লজ্জাজনকভাবে পতনের সম্মুখীন করেছে।

অনেক বিশ্লেষক এমনও মনে করেন, বিএনপির নেতৃত্ব সজাগ ও বাস্তবতামুখী হলে ১/১১-এর সংকট তৈরি হতো না। সে সময় কৌশলজনক অবস্থান নিয়ে দেশের গণতন্ত্র ও দলকে বিপর্যয়ের কবল থেকে বাঁচাতে পারতো বিএনপি।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। মোট ২১০টি আসন নিয়ে চারদলীয় ঐক্যজোট ক্ষমতায় উপবিষ্ট হয়। এ সময়ে চাপাইনবাবগঞ্জের কানসাট এ বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলনে পুলিশের নির্মম হত্যাযজ্ঞে ১০ জনের অধিক গ্রামবাসী হত্যা, ঢাকার শণির আখড়ার বিদ্যুৎ ও পানির দাবিতে সাধারণ জনতার আন্দোলনের মত কয়েকটি আন্দোলন হয়।

এছাড়াও সরকারি ত্রাণ তাহবিল থেকে ত্রাণ সামগ্রী সরকারিদলের সাংসদদের লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ সরকারের বৈধ মেয়াদ ২০০৬ সালের ৬ অক্টোবর শেষ হওয়ার পর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে দেশে শুরু হয় ব্যাপক রাজনৈতিক সংঘাত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে বিচারপতি কেএম হাসানকে মেনে নিতে রাজি হয় নি আওয়ামী লীগ।

প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মদ একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের যৌথ দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং উপদেষ্টাদের সঙ্গে নানা ধরনের মত-পার্থক্য হওয়ায় পরিস্থিতি নাজুক আকার ধারণ করে। পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট সারাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন।

আর এ সময় থেকে প্রায় দুই বছর দেশ পরিচালনা করেন ড. ফরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিএনপির আবদুর রহমান বিশ্বাস যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখনও ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের সঙ্গে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস একজন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ হওয়ায় প্রবল চাপের মুখেও ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন সেটা পারেন নি। তিনি সামরিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ১/১১ সময়কালে যারা বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তারা শুধু বিএনপির দ্বারা উপকৃতই ছিলেন না, বিএনপিপন্থী বলেই পরিচিত ও সুবিধা প্রাপ্ত ছিলেন।

এরাই যখন বিএনপিকে ঘায়েল করে, তখন সেটাকে প্রতিহত করার মতো প্রশাসনিক বা সাংগঠনিকভাবে বিকল্প ব্যবস্থা বিএনপি হাতে রাখে নি। ক্ষমতায় থেকেও সেদিন বিএনপি ছিল ব্যর্থ, নিঃসঙ্গ ও অসহায়।

বিতর্কিত ১/১১-এর সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩০ আসন নিয়ে জয়লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

এ নির্বাচনে মাত্র ২৯টি আসন পায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং ২৭টি আসনে জয়লাভ করে জাতীয় পার্টি। ১/১১-এর বিতর্কিত সরকারের অধীনের নির্বাচনে বিএনপি যে ন্যায্য সুবিধা পাবে না, এটা জানার পরেও কেন সেদিন দলটি নির্বাচনে গিয়েছিল এবং অবৈধ সরকারকে বৈধতা পাওয়ার পথ করে দিয়েছিল? বরং আপোসহীন নেত্রীর ইমেজে-দৃপ্ত বেগম খালেদা জিয়া এরশাদের আমলের ১৯৮৬ সালে পাতানো নির্বাচনে না-যাওয়ার মতো এ নির্বাচনেও যদি অংশ গ্রহণ না-করতেন, তবে তাঁর ইমেজ উজ্জ্বলতর হতো এবং ১/১১-এর বিতর্কিত সরকার বৈধতা নিয়ে সরে যেতে পারতো না। বাংলাদেশও গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে অগণতান্ত্রিক শাসনের প্রলম্বিত প্রক্রিয়ায় আবর্তিত হতো না। একইভাবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে না-যাওয়ার ক্ষেত্রেও সমালোচনা রয়েছে।

বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে দলের নেতা-কর্মীরা মাঠে সরব থাকতে পারতো এবং প্রয়োজনে নির্বাচনের আগ-মুর্হূতে বর্জন করে সরে আসলে আওয়ামী লীগ বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে আপোস করতে বাধ্য হতো।

এমন পরিস্থিতিতে বেগম খালেদা জিয়াও ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ আন্দোলনে একাকী হয়ে যেতেন না; দলের প্রার্থী, নেতা-কর্মীরা তার সঙ্গে থাকতেন। বলা হয় ১/১১-এর পর যাদের কথায় নির্বাচনে বিএনপি গিয়েছিল, তাদের কথাতেই পরের বার নির্বাচনে যায় নি। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষে নিজের সিদ্ধান্তের বদলে অন্যের কথা শোনা ও নির্ভরশীল হওয়া দলের জন্য লাভ না ক্ষতির কারণ হয়েছে, সে প্রশ্নও এখন জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে।

পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতিতে দল হিসাবে বিএনপির ভবিষ্যত এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থে দলটির ভূমিকার প্রসঙ্গও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, রাজনৈতিক দল হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘লাইফ-লাইন’ বা ‘প্রাণরেখা’। রাজনীতি পরিচালিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে।

বস্তুত দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি রাজনীতির মূল চালিকা। বিএনপি তার চালিকা ক্ষমতাকে কিভাবে ব্যবহার করে তার উপর দলটির ভবিষ্যতের সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্বের প্রশ্নও জড়িত। এ প্রশ্নে বিএনপি স্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারছে না।

দ্বিধাগ্রস্থভাবে হতাশার চক্করে আবর্তিত হচ্ছে। দলীয় কর্মী ও সমর্থক গোষ্ঠীকে কর্মসূচির পরিচ্ছন্ন দিক-নিদের্শনায় আনার ব্যর্থতা বিএনপিকে হতাশার গহ্বরে ফেলে দিয়েছে।

অতীতের সাফল্য-ব্যর্থতার শিক্ষায় বিএনপি ভবিষ্যতে নিজের হতাশ ও স্থবির অবস্থা কাটিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সঠিক পথটি বেছে নিতে পারে কিনা, সেটাই এখন সবার সামনে বিরাট বড় এক প্রশ্ন। (বাংলানিউজ)

Share