দফায় দফায় বাড়ছে ওষুধের দাম, মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের কপালে চিন্তার ভাঁজ

চাল, ডাল, মাছ, মাংস, ডিমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো কিনতে হাত পুড়ছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের। ৫০ হাজার টাকা মাসিক আয়েও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে। এরমধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আছে ওষুধের মতো অতিপ্রয়োজনীর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।   

দফায় দফায় ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে মানুষের। ওষুধের বাড়তি দামের কারণে সংসার খরচের হিসাব নতুন করে করতে হচ্ছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো জোর করেই ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি করছে এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরও অনেকটা বাধ্য হয়ে বর্ধিত দাম অনুমোদন করছে। 

খুচরা পর্যায়ে ওষুধের দাম দেখতে রাজধানীর একাধিক ফার্মেসি ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ৭০ শতাংশ ওষুধই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজার থেকে তাদের বাড়তি দামে কিনে আনতে হচ্ছে। ফলে সেই ওষুধ কম দামে বিক্রির কোনো সুযোগ তাদের নেই। 

১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে ২৩৪টি ওষুধের দাম

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের শীর্ষ ছয়টি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি তাদের উৎপাদিত ২৩৪টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। ১০ শতাংশ থেকে শুরু করে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে ওষুধগুলোর দাম। আরও ১০টি প্রতিষ্ঠান তাদের ওষুধের দাম বাড়াতে অধিদপ্তরে আবেদন করেছে।

দাম বৃদ্ধির তালিকায় সবার শীর্ষে রয়েছে অপসোনিন ফার্মা লিমিটেড, প্রতিষ্ঠানটি গত কয়েকমাসে ৫২টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যাস লিমিটেড ৪৭টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ৪৬টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড বাড়িয়েছে ৩৯টি ওষুধের দাম।

এছাড়াও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ৩৬টি ওষুধের এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ১৪টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে।

একমাস আগেও ভিটামিনজাতীয় এক পাতা বেক্সট্রাম সিলভার এবং বেক্সট্রাম গোল্ড ট্যাবলেটের দাম ছিল ২৭০ টাকা, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা করে। অর্থাৎ এক পাতা ওষুধেই মাস ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৯০ টাকা। একমাস আগেও একটি প্রোজেস্ট ট্যাবলেটের দাম ছিল ৩০ টাকা করে, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা করে। অ্যান্টিবায়োটিক সেফ-থ্রি (২৫০ মি.গ্রা.) ট্যাবলেটের দাম ছিল প্রতিটি ৩৫ টাকা করে, যা এখন হয়েছে ৪৫ টাকা, ৪০০ মি.গ্রা. সেফ-থ্রি ট্যাবলেটের দাম ছিল প্রতিটি ৪৫ টাকা, যা এখন হয়েছে ৫৫ টাকা, জক্স (১০০ মি.গ্রা.) সিরাপ আগে ছিল ৩৫ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। 

বিক্রেতাদের দেওয়া তথ্য মতে, লরিক্স ক্রিম আগে ছিল ৫৫ টাকা, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়, অ্যান্টাসিড প্লাস ট্যাবলেট প্রতিপিস দুই টাকা থেকে এখন হয়েছে আড়াই টাকা, জিম্যাক্স (৫০০ মি.গ্রা.) ছিল ৩৫ টাকা পিস, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা করে। এজিসিন (৫০০ মি.গ্রা) আগে বিক্রি হতো ৩৫ টাকা করে, এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়, ক্যালসিয়ামের ওষুধ অস্টোক্যাল ডি একমাস আগেও বিক্রি হয়েছে ২১০ টাকা করে, এখন বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকা করে। ভিটামিন ওষুধ নিউরো-বি ট্যাবলেট ২৪০ টাকা ছিল, এর বর্তমান দাম ৩০০ টাকা।

মধ্যবাড্ডা ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকার একটি ফার্মেসিতে গিয়ে দেখা গেছে, দোকানের ভেতরে সারি সারি করে ওষুধের বক্স সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

জানতে চাইলে ওষুধ বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, বেশি দামে বিক্রির আশায় বড় ব্যবসায়ীরা ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। যে কারণে বাধ্য হয়েই আমাকে কিছু ওষুধ কিনে এনে রেখে দিতে হয়েছে। নয়তো দু’চারদিন পর আমার ফার্মেসিতেই ওষুধগুলো পাওয়া যাবে না।

দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত দুইমাসে ইবনে সিনাসহ হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি ছাড়া অন্যান্য কোম্পানির প্রায় ৭০ শতাংশ ওষুধেরই দাম বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় যে ওষুধগুলো আছে, সেগুলোরই দাম বেড়েছে। শুনেছি কিছুদিনের মধ্যে আরও কিছু ওষুধের দাম বাড়বে।

বাড্ডা এলাকার মেডিসিন কর্নার নামক একটি ফার্মেসির মালিকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ওষুধের দাম বৃদ্ধি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এমন কোনো মাস নেই, যে মাসে ওষুধের দাম বাড়ে না। গত দুই মাসে প্রায় প্রতিটি ওষুধেরই দাম বেড়েছে। শোনা যাচ্ছে আবারও দাম বাড়তে পারে।

তিনি বলেন, ওষুধের দাম বাড়া-কমায় কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যখন যার যত খুশি দাম বাড়িয়ে ফেলেছে। সরকার যদি একবার বলে যে দাম বাড়বে, এইটুকু বললেই হয়ে যায়। রাতারাতি সব কিছুর দাম বেড়ে যায়, এমনকি অটোমেটিক বর্ধিত দাম কার্যকরও হয়ে যায়। কারণ দাম মনিটর করার আসলে কেউ নেই।

দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে এই বিক্রেতা বলেন, ঠিক কী কারণে বেড়েছে এটা আসলে আমরা বলতে পারছি না। এটা তো বলা যাবে না যে তেলের দাম বাড়ায় ওষুধের দাম বেড়েছে, কারণ তেলের সাথে ওষুধের কোনো সম্পর্ক নেই। ওষুধের দাম বাড়ার বিষয়টি তো তেলের দাম বাড়ার আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে বাড়তি দামে ওষুধগুলো বাজারে এসেছে গত কয়েকদিনে।

বাচ্চু মিয়া নামে আরেকজন ওষুধ বিক্রেতা বলেন, আমাদের ছোট দোকান। স্টক তো করে বড় বড় দোকানগুলো। কোম্পানিগুলোও স্টক করে। সিপ্রোসিন ওষুধ পাচ্ছি না। টোফেন সিরাপও কম। খুঁজেও পাচ্ছি না। তার মানে শিগগিরই এগুলোর দামও বেড়ে যাবে। 

যাদের সংসার চালাতে হাঁসফাঁস রোগে ভুগে তাদের মরতে হবে

ওষুধের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ প্রায় সব কিছুরই দাম বেড়েছে। এখন আবার ওষুধের দাম বেড়েছে, এটি আসলে সাধারণ মানুষের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। মানুষ আসলে কোথায় যাবে, কী করবে? মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষের সংসার চালাতেই তো এখন হাঁসফাঁস অবস্থা। এই অবস্থায় ওষুধের দাম বাড়ালে তো সাধারণ মানুষকে রোগে ভুগে মারা যেতে হবে।

তিনি বলেন, যাদের সক্ষমতা আছে, ব্যাংকে টাকা আছে, তাদের জন্য খুব বেশি সমস্যা হবে না। কিন্তু যাদের নেই, যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের ওষুধের পেছনে বাড়তি খরচ করার উপায় নেই। তাহলে তাদের হয় অন্য জিনিস স্যাক্রিফাইস করতে হবে, চাল-ডাল খাওয়া বন্ধ করতে হবে, বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে হবে, আর নয় তো চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতে হবে।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, একজন চাকরিজীবী হিসেবে আমাদের হয়তো নাভিশ্বাস হচ্ছে, তাহলে এই যে গরিব মানুষ, যাদের নুন আনতেই পান্তা ফুরায়, তাদের অবস্থা কেমন হচ্ছে? মানুষ তো তিনবেলার জায়গায় দুইবেলা খেয়েও কোনোরকম বাঁচতে পারে। কিন্তু কেউ যদি অসুস্থ হয়, আর যদি চিকিৎসা না করা যায় তাহলে তো মরা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

টাইমস ডেস্ক/১১ জুন ২০২৩

Share