চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক । আপডেট: ০২:৪৯ অপরাহ্ণ, ২৮ জুলাই ২০১৫, মঙ্গলবার
আইন ও নীতিমালা প্রনয়ন এবং প্রয়োগের মাধ্যমেও বরিশালের নারীদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছেনা। পুরুষের সহযোদ্ধা হিসেবে মর্যাদা পাওয়া নারীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি এ সহিংসতা হ্রাস পাওয়াতো দূরের কথা প্রতিনিয়তই তা বেড়ে চলেছে। সমানহারে নারীরা ঘরে ও বাইরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। যৌতুকের জন্য নির্যাতন ও খুন, স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের শ্লীলতাহানী, উত্যক্ত, ধর্ষণ কিংবা নগ্ন ভিডিও চিত্র ধারনের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে এখন নিত্যনৈমেত্তিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা গেছে, গৃহে স্বামীর দ্বারা মানসিক নির্যাতনের শিকার ৮১ দশমিক শূন্য ৬ ভাগ নারী। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় ৬৪ দশমিক শূন্য ৬ ভাগ। যৌণ নির্যাতনের শিকার ৩৬ দশমিক শূন্য ৫ ভাগ। এক্ষেত্রে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ সুরক্ষা আইন ২০১০ এ তেমন কোন সুফল নেই। বিশেষ এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চলতি মাসে বরিশাল বিভাগে নির্যাতন করে ৫ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষনের পর ভিডিও চিত্র ধারন করা হয়েছে চার জনের। স্কুলে ধর্ষিত হয়েছে দু’ছাত্রী, মা-বাবা ও ভাইকে বেঁধে ধর্ষন করা হয়েছে এক ছাত্রীকে। অপহরনের পর গণধর্ষনের শিকার হয়েছে এক কিশোরী। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ৪ জন। আর সর্বশেষ যৌতুকের দাবিতে এক গৃহবধূকে গরম আয়রন দিকে ছ্যাকা ও এক যুবতীকে গাছের সাথে বেঁধে রাতভর মধ্যযুগীয় কায়দার নির্যাতন করা হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের এ চিত্র শুধু গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
সূত্রমতে, গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ রূপাতলীয় এলাকায় ধান গবেষনা রোডের একটি বাসার সম্মুখে এক ষোড়শীকে বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে কোমড়ে শিকল ও দুটি গাছের সাথে দুই হাত রশি দিয়ে বেঁধে রাতভর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে। পরেরদিন সকালে বাঁধা অবস্থায়ই নির্যাতিত যুবতীকে উদ্ধার করে পুলিশ হেফাজতে দিয়েছেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফিরোজ আহম্মেদ। নির্যাতিত ওই যুবতীর নাম রিপা আক্তার (১৯)। সে জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কাকুলিয়া গ্রামের চুন্নু আকনের কন্যা।
রিপা জানান, নগরীর সোনারগাঁও টেক্সটাইল মিলে কাজ করার সুবাধে তিন বছর পূর্বে দক্ষিণ রূপাতলী ভাড়া বাসায় বসবাসের সময় তার সাথে স্থানীয় শাহাদাত হোসেন মিঠুন নামের এক যুবকের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে বিয়ের প্রলোভনে মিঠুন তার সাথে দৈহিক মেলামেশা করতে থাকে। পরবর্তীতে রিপা বিয়ের জন্য মিঠুনকে চাঁপ প্রয়োগ করলে সে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে পালিয়ে ঢাকার গাজীপুরে বসবাস শুরু করে। প্রেমের স্বীকৃতি আদায়ে রিপাও বরিশালের চাকুরী ছেড়ে গত ৪ মাস পূর্বে গাজীপুরের একটি সোয়েটার কারখানায় চাকুরী নিয়ে মিঠুনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। সু-চতুর মিঠুন কৌশলে প্রেমিকা রিপাকে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়।
গত ২ জুন জয়দেবপুর থানা পুলিশ রিপাকে উদ্ধারের পর মিঠুনকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় মিঠুন কারাভোগের পর গত ১৪ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পায়। গত ২২ সেপ্টেম্বর সকালে বিষয়টি নিয়ে সমঝোতার কথা বলে মিঠুনের পিতা সানু হাওলাদার মোবাইল ফোনে রিপাকে তার বাড়িতে আসার অনুরোধ করেন। সে অনুযায়ী ওইদিন রাত নয়টার দিকে রিপা তাদের ঘরে আসার পর সানু হাওলাদার জানতে চায় মামলা তুলে নেয়া হবে কিনা। পুরো বিষয়টির সুরহা ছাড়া মামলা তুলে নিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় রাত ১০টার দিকে সানু ও তার লোকজনে কৌশলে দুটি গাছের সাথে রশি দিয়ে রিপার দুই হাত এবং শিকল দিয়ে পাশ্ববর্তী বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে কোমড় বেঁেধ মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে। রিপার ডাক চিৎকারে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসলেও প্রভাবশালী সানু হাওলাদারের ভয়ে এলাকার কেহ মুখ খুলতে কিংবা প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি।
নগরীর ২৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোঃ ফিরোজ আহম্মেদ জানান, স্থানীয়দের কাছে খবর পেয়ে পরেরদিন (২৩ সেপ্টেম্বর) সকালে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে বাঁধা অবস্থায় নির্যাতিত তরুনীকে উদ্ধার করে নিজ দায়িত্বে পুলিশ হেফাজতে দিয়েছেন। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে কোতয়ালী থানার ওসি শাখাওয়াত হোসেন জানান, এ ঘটনায় নির্যাতিত রিপা আক্তার বাদি হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেছেন। আসামিদের মধ্যে ছয়জনকে (২৪ সেপ্টেম্বর) গ্রেফতার করা হয়। অন্যান্যদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশী অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও ওসি উল্লেখ করেন।
অপরদিকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে কলেজ ছাত্রীর অশ্লীল ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে গৌরনদী উপজেলার সরিকল বাজার থেকে রিয়াদ হোসেন রাঢ়ী নামের এক বখাটে যুবককে গ্রেফতার করেছে বাবুগঞ্জ থানা পুলিশ। এ সময় গ্রেফতারকৃত বখাটের কম্পিউটার থেকে দেড় হাজার পর্ন ছবি উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। ওই বাজারের রিয়াদ কম্পিউটার প্লাজায় স্বত্তাধীকারি বখাটে রিয়াদ হোসেন (২৬) দীর্ঘদিন থেকে বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেনীর এক ছাত্রীর সাথে প্রেমের সর্ম্পক গড়ে তোলে। অতিসম্প্রতি তাদের সম্পর্কে অবনতি হলে রিয়াদ কম্পিউটারের মাধ্যমে ওই ছাত্রীর পর্ণ ছবি বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর মা বাদি হয়ে থানায় বখাটে যুবক রিয়াদের বিরুদ্ধে পর্নগ্রাফী আইনে মামলা দায়ের করেন।
গত ৯ সেপ্টেম্বর দাম্পত্য কলহের জেরধরে বাকেরগঞ্জে তানিয়া আক্তার (১৮) নামের এক গৃহবধূকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ নিহতের স্বামী, শ্বশুড় ও শাশুরিকে গ্রেফতার করেছে। একই কারনে ১৩ সেপ্টেম্বর গৌরনদীর আশোকাঠী গ্রামে স্বামীর লাঠির আঘাতে চার সন্তানের জননী মমতাজ বেগম (৪৫) নিহত হন।
১৫ সেপ্টেম্বর বরগুনা থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া কিশোরীকে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালক অপহরন করে। চারদিন ওই কিশোরীকে আটকে রেখে গণধর্ষন করা হয়। অপহৃতা কিশোরীর পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের পর পুলিশ ২১ সেপ্টম্বর তাকে উদ্ধার করে। ১৬ সেপ্টেম্বর উজিরপুর হস্তিশুন্ড গ্রামে যৌতুকের দাবিতে স্বামী রতন শীল ও তার পরিবারের অমানুষিক নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন গৃহবধূ বাসন্তী বাড়ৈ। পুলিশ শ্মশান থেকে ওই গৃহবধূর অর্ধদগ্ধ লাশ উদ্ধার করেন।
১৯ সেপ্টেম্বর ভোলার লালমোহন হাসপাতালে রিনা বেগম (২১) নামের এক গৃহবধূর লাশ ফেলে পালিয়ে গেছে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজনে। প্রথমে গৃহবধূর অসুস্থতার কথা বলে হাসপাতালে নিয়ে আসা হলেও তার মুখে বিষের গন্ধে চিকিৎসকদের সন্দেহ হলে গৃহবধূর শ্বশুড় বাড়ির লোকজনে পালিয়ে যায়। এরমাত্র একদিন পূর্বে একই হাসপাতালে লাইজু বেগম (২৭) নামের দুই সন্তানের জননী মারা গেছে। তাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে।
এছাড়া ১৯ সেপ্টেম্বর বরিশাল নগরীতে যৌতুকের জন্য গরম আয়রন দিয়ে জোসনা বেগম নামের এক সন্তানের জননীকে ছ্যাঁকা দেয়া হয়। ৫ সেপ্টেম্বর ভান্ডারিয়ায় ফেনসি আক্তার ও ৯ সেপ্টেম্বর উজিরপুরের গুঠিয়া আইডিয়াল কলেজের ছাত্রী সোনিয়া আক্তার অজ্ঞাত কারনে আত্মহত্যা করে। ১৩ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদে রোজিনা আক্তার নামে এক তরুনী আত্মহত্যা করেছে। ৭ সেপ্টেম্বর নলছিটিতে বাবা ও ভাইকে বেঁধে ৮ম শ্রেনীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে দুবৃত্তরা।
১১ সেপ্টেম্বর বানাড়ীপাড়ায় যৌণ হয়রানীর শিকার হয় খালিশাকোঠা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেনীর এক ছাত্রী। ১১ সেপ্টম্বর সদর উপজেলার রায়পাশা কড়াপুরে পপুলার মাধমিক বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে বিদ্যালয় কক্ষেই ধর্ষণ করেছে চিহ্নিত বখাটেরা। ১২ সেপ্টেম্বর বানারীপাড়ায় এক যুবতীকে ধর্ষন ও তার ভিডিও চিত্র ধারনের ঘটনা ঘটে। ১৪ সেপ্টেম্বর আগৈলঝাড়ায় কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষন ও তার ভিডিও চিত্র ধারন করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হয়। একইদিন মেহেন্দিগঞ্জে ৫ম শ্রেনীর এক ছাত্রী ধর্ষনের শিকার হয়েছে।
এ সকল ঘটনায় মামলা, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালন করা হলেও বখাটেরা প্রভাবশালী হওয়ায় বরাবরেই নির্যাতিতরা বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে নারী নির্যাতনের ঘটনা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রাশিদা বেগম, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা একেএম আখতারুজ্জামান, মহিলা পরিষদের সভানেত্রী রাবেয়া খাতুন সম্মিলিত ভাবে বলেন, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ পাশ হলেও এখন পর্যন্ত আইনটির প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
আইনটি কেবল পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য। এজন্য পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কারো দ্বারা নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হলেও নির্যাতনকারীকে এই আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এছাড়া আদালত, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী রাহিনী, প্রয়োগকারী কর্মকর্তাসহ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের যথাযথ সমন্বয়হীনতার কারনে ভূক্তভোগীরা আইনটির সুফল পাচ্ছেন না।
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫
চাঁদপুর টাইমস ডট কম–এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি