তোমার কি কোনো বান্ধবী নেই?

মাত্র বাইশ বছর বয়সে সরকারি চাকরিতে ঢুকে দেখেছিলাম কাছাকাছি বয়সের কোনো সহকর্মী নেই। পঁয়ত্রিশ থেকে ছাপ্পান্নদের সঙ্গে গোটা দিন কাটাতে হবে। প্রথমেই আমাকে তাদের একজন বললেন, তাড়াহুড়া করার দরকার নেই, ধীরেসুস্থে কাজ শেখো। সামনে সারাটা জীবন পড়ে আছে।

দেখতাম, অফিসের অন্য সেকশনের স্টাফরা ১১টায় এলেও এরা চলে আসতেন সোয়া ১০টার মধ্যে। অবশ্য আমাকে বলতেন, তোমার তাড়াতাড়ি আসার দরকার নেই। ১১টা নাগাদ এসো। তার পরে এলে লেটমার্ক পড়ে যাবে। আবার বিকাল সাড়ে ৩টা বাজলেই বলতেন, তোমার কি কোনো বান্ধবী নেই? তাকে তো সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি ফিরতে হবে। যাও, গিয়ে দেখা কর। অর্থাৎ আমার ছুটি।

এই যে, সাড়ে চার ঘণ্টা আমি চেয়ারে বসে থাকব, কাজটা কী? তখন কম্পিউটারের কথা কেউ শোনেনি। তাই পুরনো রেকর্ড থেকে পেমেন্টের নামগুলো বাদ দিয়ে নতুন রেকর্ডে অডিটস্ট্যান্ডিংয়ের লিস্ট বানানো। তখন আমি একা ঘর ভাড়া করে থাকি। হোটেলে খাই। এরা আমার পাশে বসে সংসারের গল্প করতেন কাজ করতে করতে। দুঃখের গল্প, সুখের গল্প এবং খরচ বেড়ে যাওয়ার গল্প।

ক্রমে আমি তাদের ছোট ভাই হয়ে গেলাম, যাদের সামনে সব কথা বলা যায়। দিন যত বাড়তে লাগল, তত তারা দূরত্ব কমিয়ে আনলেন। তারা যেমন কথা বলতেন তেমন কাজও করতেন। অ্যাসেসমেন্টের নিয়ম-কানুন তাদের মুখস্থ ছিল। বিকাল ৪টার সময় তারা আমাকে থাকতে দিতেন না।

একদিন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, ফ্যানের তলা থেকে উঠতে চাইছি না, সেকশনের পিয়ন মৃণালদা পাশে এসে নিচু গলায় বলল, বসে আছেন কেন? চলে যান। আপনি থাকলে তাদের নিতে অসুবিধা হবে। সারা দিনে তারা যাদের কাজ করলেন তারা এখন এসে যাবে। খুব খারাপ লেগেছিল।

তারা সরকারি কাজ করে পার্টির কাছ থেকে উেকাচ নেবেন? তাদের প্রত্যেকেই শিক্ষিত, ভদ্র, কারও পিতা বা স্বামী। দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলাম। বছরখানেক বাদে এক সিনিয়র বললেন, সামনের শুক্রবার বিকালে কোনো কাজ রেখো না হে।

ছটা নাগাদ অলিম্পিয়ায় চলে আসবে। —কেন? অবাক হয়েছিলাম। —তোমার চাকরি জীবনের এক বছর পূর্তি সেলিব্রেট করব আমরা। খুব খুশি হয়েছিলাম। এক বছর কাজ করার পর ইনক্রিমেন্ট হয়েছে ১৫ টাকা। কিন্তু অলিম্পিয়ায় জীবনে ঢুকিনি। নিশ্চয় ওখানে খাবারের দাম খুব বেশি। তবু আমাকে খাওয়াবেন। গেলাম।

তখন হইহই সময়। পানীয় এবং খাবারের ছড়াছড়ি। আমাকে দেখামাত্র একজন গ্লাস তুলে বললেন, চিয়ার্স। চাকরি জীবন সুখের হোক। প্রচুর দামি খাবার খেয়ে যখন ওঠার সময় হলো তখন দেখলাম মোটা টাকার বিল মেটালেন তারা। তারপর একটা মাঝারি প্যাকেট আমার হাতে তুলে দিলেন উপহার হিসেবে।

বাড়ি গিয়ে দেখলাম প্যাকেটের ভিতর থেকে একটা দামি ক্যামেরা বের হলো। পরদিন অফিসে গিয়ে অনুযোগ জানাতেই সিনিয়র বললেন, আচ্ছা, তুমি তো মাইনে ছাড়া অফিস থেকে কিছু নাও না, ওটা রাখো, সারা জীবন থাকবে। কিছু বলতে পারিনি। সেদিনই বৃষ্টির জন্য বিকালে বের হতে পারিনি। কিন্তু একজন পার্টি এলেন। তার কাম্য কাগজ নিয়ে একটা খাম দিয়ে গেলেন সিনিয়রকে। আমার সামনে সেটা নিতে বিন্দুমাত্র লজ্জিত হলেন না সিনিয়র।

উল্টো তাকে বলতে শুনলাম, আমরা কিন্তু একজন বেড়ে গিয়েছি। অর্থাৎ তিনি আমাকে ঝাঁকে মিশিয়ে নিলেন। কিন্তু আমার খাতির কমল না। যেহেতু আমাকে আমার ভাগের টাকা দিতে হচ্ছে না, তাই আসা-যাওয়ার ওপর যেমন নিয়ন্ত্রণ রাখলেন না তেমনি কাজের বোঝা চাপাতেন না। অন্তত যে কাজ করলে পার্টি উপকৃত হবে সেগুলো আমাকে দিতেন না। প্রতি মাসে আমাকে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁতে খেতে ডাকতেন। আমি ইতিমধ্যে জেনে গেছি, কার ছেলেমেয়ে কী করে, কার স্ত্রী খুব জাহাঁবাজ, কার স্ত্রী শাশুড়ি-দেবরকে সহ্য করতে পারেন না।

সেসব মহিলার মধ্যে কে বেশি সুন্দরী। একদিন যখন কেউ সেকশনে ছিল না, সবচেয়ে সিনিয়র বললেন, কাল তো ছুটির দিন। বিকালে এসো না আমার বাড়িতে!! ঠিকানাও দিয়ে দিলেন। গেলাম। তার মেয়ে কলেজে পড়ে। শুনলাম কিছুতেই রোগা হতে পারছে না। তার স্ত্রী বেশ সুন্দরী। বয়সের ব্যবধান স্পষ্ট।

মা বলে না ভেবে দিদি ভাবলে ভালো লাগবে। কিন্তু খুব উদাসীন। আমার সঙ্গে দু-তিনটি কথা বলে চলে গেলেন ভিতরে। চা খেয়ে যখন বেরিয়ে আসছি তখন আমাকে বাস স্টপে পৌঁছাতে এলেন ভদ্রলোক।

বললেন, খুব সমস্যায় পড়েছি হে। আমার স্ত্রী কেমন দেখতে? —ভালো। —দূর! ভালো মানে সৌন্দর্যের কথা বলছ তো! সেটাই মুশকিল হয়েছে। মেয়ে যতদিন স্কুলে পড়ত তাকে নিয়েই থাকত। সে কলেজে ওঠার পর মাকে সময় দিচ্ছে না। আলাদা ঘরে শুইছে। আমার ভয় হচ্ছে, এই ফাঁকে বেনোজল না ঢুকে যায়। —মানে? —দূর, আত্মীয়দের কেউ কেউ আসা-যাওয়া করছে। তাদের দুজন আবার বিপত্নীক। খুব তোল্লাই দিচ্ছে ওকে। আর, তুমি হয়তো জানো না, তোল্লাই পেলে সবাই খুব খুশি হয়।

Share