৯ জানুয়ারি ১৯৭২, রোববার ‘তোমরা কি সবাই বেঁচে আছো?’—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
‘তুমি কবে আসবে? ওরা আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে’—শেখ রাসেল
‘তোমরা কি সবাই বেঁচে আছো?’—সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপারে লন্ডন হইতে গতকাল সন্ধ্যায় স্বীয় পরিবারবর্গের সহিত টেলিফোনে কথা বলার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমেই এই কথা কয়টি উচ্চারণ করেন।
শেখ মুজিবের কনিষ্ঠতম পুত্র, সাত বছরের আবেগাপ্লুত ‘রাসেল’ তার বাবাকে প্রশ্ন করে, ‘আব্বা, ওরা কি তোমায় ছেড়ে দিয়েছে? তুমি কবে আসবে? ওরা কিন্তু আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে। আব্বা, এখন আমরা সবাই ভালো আছি।’
টেলিফোনে কথা বলার সময় এক অবর্ণনীয় আনন্দাতিশয্যে পরিবারের সদস্যদের চোখ হইতে অশ্রুর মালা ঝরিয়া পড়িতেছিল।
বেগম মুজিব টেলিফোনে স্বামীর সহিত কথা বলার সময় আবেগে ভাঙিয়া পড়েন। তিনি স্বামীর শারীরিক কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেন। শেখ সাহেব টেলিফোনে বেগম মুজিবকে জানান যে তিনি পরে ঢাকায় আসার স্বীয় পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁহাকে (বেগম মুজিব) অবহিত করিবেন।
শেখ সাহেবের ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনি এবং তোফায়েল আহমেদ এমএনএ-সহ অন্যান্যের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে আলাপ করেন।
বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি প্রদানের খবর তাঁহার পিতামাতাকে বিশ্বাস করাইতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয় বলিয়া তিনি জানান।
১১ জানুয়ারি ১৯৭২, মঙ্গলবার-প্রথম সাক্ষাৎ
এক মর্মস্পর্শী পুনর্মিলনী
দীর্ঘ প্রায় দশ মাসের বিচ্ছেদের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হলেন, তখন এক হৃদয়স্পর্শী পুনর্মিলন দৃশ্যের অবতারণা হয়। বিচ্ছেদের এই পুরোটা সময় তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে, তিন ছেলেসহ পরিবারের বাকি সদস্যরা কাটিয়েছেন আশা-নিরাশার দোলাচলের এক তীব্র যন্ত্রণার জীবন। খবর বিএসএস।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁর পরিবারের সদস্যদের ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ১৮ নম্বর সড়কের যে বাড়িটায় গৃহবন্দী করে রেখেছিল, শেখ মুজিব যখন সেখানে ঢুকলেন, তখন তাঁর বড় মেয়ে (শেখ) হাসিনা প্রথম তাঁকে বরণ করে নেন।
সেটা এমন এক মুহূর্ত ছিল, যা বর্ণনা করার ক্ষমতা ভাষার নেই। আবেগরুদ্ধ হাসিনার কাছেও কোনো ভাষা ছিল না। যে বাবার বুকে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তিনি নিজেই তখন কান্না সামলাতে যুদ্ধরত। সুখে আর নতুন করে পাওয়া এক নিশ্চয়তাবোধে দুজনেই কাঁদতে শুরু করলেন। মেয়ের কানে কানে অস্ফুটে কোনো একটি আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করে শেখ মুজিব এগিয়ে গেলেন সামনে। তিনি যখন বড় হলরুমে হাঁটছেন, তখন ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরী ও নারীর দল তাঁর ওপর পুষ্পবৃষ্টি করল।
হলরুমেই ছোট মেয়ে (শেখ) রেহানাসহ আত্মীয় ও অতিথিদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ হলো। তাঁদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে পরের ঘরটিতে যেতে তাঁকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হলো। তাঁর জন্য সেখানে প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁর নব্বই বছর বয়সোত্তীর্ণ বৃদ্ধ বাবা।
শেখ মুজিব পরম শ্রদ্ধায় বাবার পা ছুঁলে বৃদ্ধ মানুষটির চোখ পুনর্মিলনের আনন্দ ও গৌরবে ছলছল করে উঠল।
কিন্তু সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী মুহূর্তটির তখনো বাকি ছিল। সেই মুহূর্তটি এল কিছুক্ষণ পরে, শেখ মুজিব যখন তাঁর আশি পেরোনো মায়ের সামনে এগিয়ে গেলেন। মাকে জড়িয়ে ধরে লৌহমানব হিসেবে পরিচিত শেখ মুজিব শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পুরো ঘরের দখল নিয়ে নিল নীরবতা। এই পুনর্মিলন দৃশ্যের সাক্ষীদের অনেকেই কিছুক্ষণের মধ্যে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
শেখ মুজিব ঘরে পৌঁছেছিলেন ৫টা ৩৫ মিনিটে। বাড়ির বাইরে তখন অগণিত মানুষের ভিড়। তারা তাদের নেতাকে ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ স্লোগানে সম্ভাষণ জানাচ্ছিল।
নাচতে আর গাইতে থাকা মানুষের ভিড় বাড়ির সবকটি প্রবেশপথ এমনভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল যে শেখ মুজিবের সঙ্গে মিলিত হতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয়। প্রেসিডেন্ট মুজিব বাড়ির বসার ঘরে ৬টা ১৫ মিনিটে ফিরে এসে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
ওই মুহূর্তে কোনো ধরনের সংবাদ বিবৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মুজিব শিগগিরই একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকার কথা জানালেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেখানে উপস্থিত সাংবাদিক ও অতিথিদের অনুরোধ করলেন, যেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ করে দেন। আকাশপথে দীর্ঘ ২৭ ঘণ্টার ভ্রমণে তিনি ক্লান্ত।