অনাবাদি জমিতে হবে তেলবীজ চাষ

উৎপাদন বাড়িয়ে আগামী তিন বছরে ৮ হাজার কোটি টাকার ভোজ্য তেল আমদানি কমাতে চায় সরকার। অনাবাদি জমিতে তেলজাতীয় শস্য চাষ এবং উচ্চফলনশীল বীজ উৎসাহিত করে দেশের চাহিদার অন্তত ৪০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব বলে মনে করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও।

সরকারি এ দপ্তরটি ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করেছে। ভোজ্য তেল উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড.আবদুর রজ্জাক তার উচ্চাকাক্সক্ষার কথা বলেছেন একাধিকবার। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তেলবীজ উৎপাদন বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন।

জানা গেছে,দেশে দৈনিক মাথাপিছু ভোজ্য তেলের প্রয়োজন ৩০ গ্রাম। কিন্তু বাংলাদেশে গড়ে ২০ গ্রাম ভোজ্য তেল গ্রহণ করা হয়। ২০২০ সালে বার্ষিক মাথাপিছু তেল গ্রহণের পরিমাণ ছিল ১৫ কেজি ২০০ গ্রাম। ২০২২ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ কেজি ৪শ গ্রাম। অর্থাৎ তেল গ্রহণের মাথাপিছু পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে।

বর্তমানে দেশে ভোজ্য তেলের মোট বার্ষিক চাহিদা ২৪ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপন্ন হয় মাত্র ৩ লাখ টন। মোট চাহিদার সাড়ে ৮৭ % আমদানি করতে হয়। বিপুল পরিমাণ এ ভোজ্য তেল আমদানি করতে প্রতি বছর কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যায়। দেশে আমদানিকৃত ভোজ্য তেলের ৫৮% পামঅয়েল এবং ৩৭ % সয়াবিন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে তেলজাতীয় ফসল চাষ হয়। আগামি তিন বছরে চাহিদার ৪০ % পূরণ করতে হলে ২৪ লাখ হেক্টর জমিতে তেলজাতীয় ফসলের চাষ করতে হবে। এ লক্ষ্যে ‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ নামে একটি প্রকল্প নিয়েছে দপ্তরটি।

২০২০ সাল থেকে প্রকল্পটি শুরু হয়েছে। স্বল্প পরিসরে প্রকল্পটির কাজ চলমান থাকলেও আগামী তিন বছরের জন্য বিশদ কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের জুন মাসে শেষ হবে প্রকল্পটি।

প্রকল্পের আওতায় দেশের ৬৪টি জেলার ২৫০টি উপজেলায় সরিষা, সূর্যমুখী, তিল, চিনাবাদাম এবং সয়াবিন চাষ বাড়ানো হবে। তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনা এবং হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে সরকার।

বর্তমানে চাষকৃত তেলজাতীয় ফসলের ৩৭ শতাংশ জমিতে টরি, মাঘী এবং ধুপিসহ স্থানীয় জাতগুলো বপণ করা হয়। এর পরিবর্তে উচ্চফলনশীল বারি সরিষা-১৪, ১৭, ১৮, বিনা সরিষা-৪, ৯ এবং ১১ চাষ শুরু করতে চায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। একই সঙ্গে বোরন এবং সালফার জাতীয় সারের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায় দপ্তরটি।

এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার ৯ লাখ হেক্টর, বরেন্দ্র এলাকার ৩ লাখ হেক্টর, চর এলাকায় ৪ লাখ হেক্টর, হাওর এলাকায় আড়াই লাখ হেক্টর, পার্বত্য এলাকায় ১৬ লাখ হেক্টর অনাবাদি জমিকে তেলজাতীয় ফসলের আওতায় আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে দুই ফসলের মধ্যবর্তী সময়ে দ্রুত ফলনশীল তেলবীজ চাষের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।

তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক জসীম উদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে জরিপ ও তথ্যের ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তা বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। আমরা আশা করছি ২০২৫ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটানো যাবে। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বেঁচে যাবে।’

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে,আমদানিনির্ভর যেকোনো পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। কারণ নিজেদের প্রয়োজনে উৎপাদনকারী দেশ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। আবার দামের বিষয়টিও তাদের ওপর নির্ভর করে। ইতোমধ্যে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার নজির ভোক্তারা অনেকবার দেখেছেন।

ফলে আমদানিনির্ভরতা কমানোর চেয়ে ভালো বিকল্প সরকারের হাতে নেই। সামনের দিনগুলোতে খাদ্যশস্য নিয়ে নানা ধরনের জটিলতা শুরু হতে পারে। তাই আগাম সতর্কতার অংশ হিসেবে সরকার যে উদ্যোগটি নিয়েছে তা অবশ্যই সুখকর। কিন্তু পরিকল্পনামতো কাজ যেন করা হয়, সে বিষয়টি ঠিকমতো দেখভাল করতে হবে। নয়তো অর্থ খরচ করেও সুফল পাওয়া যাবে না।

এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড.জাহাঙ্গীর আলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ভোজ্য তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশসংনীয়। এতে তেলের বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে, কমবে আমদানিনির্ভরতা। তবে উদ্যোগটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না সে বিষয়টি মনিটরিং করার জন্য সরকারকে দায়িত্বশীল হতে হবে।’

কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন,‘বিপুল অর্থ আমাদের খরচ করতে হয় তেল আমদানিতে। তাই প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। আশা করছি এতে দেশের কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই সুফল ভোগ করবে।’

২৫ ডিসেম্বর ২০২২
এজি

Share