প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) তুলে দিতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন দেশের শিক্ষাবিদরা। কোমলমতি শিশুদের ওপর পরীক্ষার সময় যে চাপ তৈরি হয়, সেটিকে ‘বিভীষিকা’ উল্লেখ করে শিশুদের কৈশোরের আনন্দ ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানিয়ে আসছেন তাঁরা। বিভিন্ন মহল থেকে ওঠা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী থেকে সরে আসার ইঙ্গিত মিলেছে সরকারের পক্ষ থেকে।
২৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর বিকল্প ভাবতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পরীক্ষার নামে বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা দিতে দিতে বাচ্চারা ক্লান্ত। পরীক্ষা কোমলমতি বাচ্চাদের শেষ করে দিচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়ে এসে বিকল্প কিছু বের করতে হবে। এ ছাড়া তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
সভা সূত্রে জানা গেছে, পিইসি তুলে নেওয়া ও তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখার বিষয়টি আলোচনায় আসে ‘ঢাকা মহানগরী ও পূর্বাচলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দনকরণ’ প্রকল্পটি অনুমোদনের সময়। প্রধানমন্ত্রী এ সময় বলেন, বাচ্চাদের কাঁধে অনেক বেশি বই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাচ্চাদের ওপর থেকে বইয়ের বোঝা কমাতে হবে। পিইসি না নিতে বিভিন্ন জায়গা থেকে আলোচনা হচ্ছে। আমিও একমত এই পরীক্ষা না নিতে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। পরীক্ষা হবে; তবে সেটি স্কুলের দৈনন্দিন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে। সেখানেই মার্কিং হবে।
বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশে প্রথমবারের মতো প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী বা পিইসি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এত দিন সরকারের যুক্তি ছিল—পিইসি পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় এবং পরীক্ষার ভীতি দূর হয়।
গতকালের একনেক সভায় আলোচনায় উদাহরণ হিসেবে আসে অস্ট্রেলিয়ার নাম। দেশটিতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হয় না। দেশে ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখার কথা বলা হয়েছিল। যদিও মন্ত্রণালয় থেকে সেটি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। গতকাল প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা রাখার প্রয়োজন নেই। বিদ্যালয়ে দৈনন্দিন পরীক্ষা কার্যক্রম চলতে পারে।
একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, পড়াশোনার চেয়ে বাচ্চাদের বেশি করে খেলাধুলার দিকে নজর দেওয়ার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে খেলাধুলার পরিবেশ তৈরির কথাও বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী কোমলমতি শিশুদের বইয়ের ভার কমাতে বলেছেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পিইসি পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তিন বছর আগে ২০১৬ সালে একবার আলোচনা হয়েছিল সরকারের মধ্যে। তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার পিইসি পরীক্ষা তুলে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। যদিও পরে তা কার্যকর হয়নি। গতকালের সভায় প্রধানমন্ত্রী পিইসির বিকল্প ভাবতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে আরো নতুন নতুন চিন্তাভাবনা করার জন্য বলেছেন। শিশুদের বই ও পরীক্ষার চাপ থেকে মুক্ত করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, পিইসি নিয়ে দুটি পক্ষ আছে। কেউ বলছেন ভালো। আবার কেউ বলছেন ভালো না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পরীক্ষার বিকল্প ভাবতে।
শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ অন্যরা বলে আসছেন, লেখাপড়ার নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর যে রকম নির্যাতন আর অত্যাচার করা হয় সেটি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। পরীক্ষা আর বইয়ের চাপে শিশুরা কৈশোরের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গতকালের একনেক সভায় ঢাকা মহানগরীর ১৫৪টি বিদ্যালয়ের দুই হাজার ৯৭৫টি কক্ষ নতুনভাবে নির্মাণ, উত্তরাতে তিনটি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও পূর্বাচলে নতুন করে ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনসংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হবে এক হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এই টাকা জোগান দেওয়া হবে। ২০২৪ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। (কালেরকণ্ঠ)
বার্তা কক্ষ, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯