তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালযের চারটি শ্রেণিতে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা তুলে দিয়ে চালু হচ্ছে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। আচার-আচরণ, সারা বছর ক্লাসে পর্যবেক্ষণ, সাপ্তাহিক ও মাসিক পরীক্ষাসহ বিভিন্নভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিবিড় তদারকিতে রাখা হবে।
শিশুর শোনা, বলা, পড়া ও লেখার যোগ্যতা ও দক্ষতা নিরুপণ করে এর ভিত্তিতে পরবর্তী শ্রেণিতে পদোন্নতি দেয়া হবে। কয়েকদিনের মধ্যে দেশের ১০০টি নির্বাচিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ পদ্ধতি পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হবে।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দে দেশের সরকারি-বেসরকারিসহ সব ধরনের বিদ্যালয়ে এটি চালু হবে। শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি প্রশংসনীয় ও সময়োচিত পদক্ষেপ।
শিশুদের মূল্যায়ণ করা হবে কিন্তু তাদের বুঝতে দেয়া যাবে না। তারা বিদ্যালয়ে আনন্দে কাটাবে, কিন্তু তাদের মনোযোগ কোনদিকে, ঝোঁক কিসের প্রতি সে বিষয়গুলো লক্ষ করার দায়িত্ব শিক্ষক, অভিভাবক, বিদ্যালয় এবং সংশ্লিষ্টদের।
একটি শিশুর ঝোঁক ও আগ্রহ কোনদিকে সেই অনুযায়ী তার ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনা,ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণ করে দিতে হবে শিক্ষক ও বিদ্যালয়কে। সেটি কোনোভাবেই প্রচলিত সবার জন্য খাতা কলম নিয়ে কয়েকটি পঠিত প্রশ্ন থেকে উত্তর লিখতে পারার মতো মূল্যায়ন নয়।
সেটি কারুর ক্ষেত্রে হতে পারেঅ কিন্তু দুরন্ত, চঞ্চল শিক্ষার্থীটি যে ভবিষ্যতে হয় খেলোয়াড় হবে,কিংবা রাজনীতিবিদ হবে তার জন্য সেই খাতা-কলমের পরীক্ষা সঠিক নাই হতে পারে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা কাজে নাও লাগতে পারে। আবার যে শিশুটি বিজ্ঞানী হবে, আবিষ্কারক হবে তার জন্যও এ ধরনের পরীক্ষা খুব একটা কাজে নাও লাগতে পারে। কিন্তু আমরা সকল শিশুর জন্য একই ধরনের মূল্যায়নের ব্যবস্থা করে তাদের একটি সিল মেরে দিচ্ছি কে ভালো-কে খারাপ শিক্ষার্থী।
আমাদের প্রচলিত পদ্ধতি, শিক্ষক, সকলের মানসিকতা শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিরাট বাধা। সেই কঠিন কাজটি করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবি। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম আল হোসেন বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী শিশু থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত চারটি ক্লাস থেকেই আমরা আনুষ্ঠানিক বা সাময়িক পরীক্ষা তুলে দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের অধীনে এনে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। শিশুর লেখাপড়ার বাইরে ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি, পাঠে মনোযোগ, লেখাপড়ায় পারঙ্গমতা, পোশাক পরিচ্ছদ, ব্যবহার ইত্যাদি বিবেচনায় নেয়া হবে।” সারা বছর ধরে এসব বিষয়ে দেয়া নম্বরের আলোকেই পরবর্তী শ্রেণিতে পদোন্নতির উপযুক্ততা নির্ধারণ করা হবে। শিক্ষার্থীদের ফলাফলভিত্তিক কোনো রোল নম্বর থাকবে না।
এর পরিবর্তে তাদের একটি পরিচিতি নম্বর দেযা হবে। ধারাবাহিক মূল্যায়নে নম্বরের পরিবর্তে দেয়া হবে লেটার গ্রেড বা ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ ইত্যাদি। শিশুদের লেটার গ্রেডও দেয়া হবে কি না বিষয়টি আর একবার ভেবে দেখা প্রয়োজন। শিশুদের মূল্যায়নের বিষয়টি শিক্ষাবিদদের ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এবং এনসিটিবির বলার ও করার কথা। সেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী বিষয়টি নিয়ে ভেবে এবং একটি চমৎকার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে আমরা তাকেও অজস্র ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন তৃতীয় শ্রেণি থেকে পরীক্ষা উঠিয়ে দেয়ার প্রস্ততি হিসেবে গোটা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম নতুনভাবে তৈরি করতে হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের দিতে হচ্ছে প্রশিক্ষণ। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অধীনে ১০০ স্কুলে পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের ট্রাইআউট বা পরীক্ষা শুরু হবে।
দৈবচয়ন ভিত্তিতে নির্বাচিত ওইসব স্কুলে নেয়া হবে না কোনো পরীক্ষা। যেহেতু বিদ্যমান পাঠ্যপুস্তক দক্ষতা নিরূপণের উপযোগী করে লেখা, যা তিনটি সাময়িক পরীক্ষার মাধ্যমে শিখণফল যাচাই করা হয় । তাই এ পাঠ্যপুস্তকেই ধারাবাহিক মূল্যায়ণ করতে এনসিটিবির বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ট্রাইআউট চলছে। তবে, ট্রাইআউটের ফলাফল জাতির সামনে স্পষ্টভাবে পেশ করতে হবে যাতে শিশুশিক্ষা সম্পর্কে সবাই জানতে পারে, শিশুদের জন্য কি ধরনের ব্যবস্থা বিদ্যালয়ে ও বাড়িতে হওয়া উচিত, থাকা উচিত তা যাতে সবাই বুঝতে পারে। আমরা শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজ শিশুদের ওপর পরীক্ষার নামে যে অত্যাচার করে যাচ্ছি সে সম্পর্কে সবারই সচেতনতা জাগ্রত করতে হবে।
এ ১০০ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োগফলের ভিত্তিতে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে দেশের সব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োগ করা হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। চমৎকার সিদ্ধান্ত বটে! প্রথম কোনো বিষয়কে চালু করার আগে পাইলটিং করতে হয়, একশত বিদ্যালয়ে সেই পাইলটিংই হতে যাচ্ছে যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। তবে চতুর্থ শ্রেণি থেকে যথারীতি তিনটি করে পরীক্ষা থাকবে। থাকবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাও।
কর্তৃপক্ষকে এসব পরীক্ষা সম্পর্কেও চিন্তা করতে হবে। কারণ পাবলিক পরীক্ষা সুন্দর শিক্ষাদানের বিকল্প নয়। বার বার পরীক্ষা গ্রহণ ও পাবলিক পরীক্ষার মধ্যে আমরা সেটিই প্রমাণ করতে যাচ্ছি, যা ঠিক নয়।
এনসিটিবি বলেছে এখন পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই দেয়া হবে। তৃতীয় শ্রেণিতে আগের নিয়মেই দেয়া হবে কিনা সেটি অবশ্য এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে সরকার তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই শেষ পর্যন্ত ওই শ্রেণিতেও নতুন শিক্ষাক্রমের বই দেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পাশাপাশি সরকার তথ্য সংগ্রহও করছে। আগামি মে মাসের মধ্যে বিদ্যালয়গুলো থেকে বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে। জুন মাসে সব তথ্য বিশ্লেষণ করা হবে। জুলাই মাসে এসব তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে এনসিটিবি। বিদ্যালয়ের শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিখন টুলস পরিমার্জন করা হবে। এরপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে আগষ্ট মাসে সাতদিন দিনব্যাপী মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। তারা ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর সারা দেশের শিক্ষকদের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
ডিসেম্বরের পরে শিক্ষকদের জন্য মূল্যায়ন নির্দেশিকা ছাপিয়ে সারা দেশে বিতরণ করা হবে। এখানে যেভাবে বলা আছে সেভাবে করা হলে আমরা প্রশংসাই করব। কিন্তু, যেনতেন প্রকারে বিষয়টি করা হলে সমস্যার অন্ত থাকবে না এবং হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
এনসিটিবির প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের সদস্য অধ্যাপক ড.রিয়াজুল হাসান বলেন, “সামষ্টিক পরীক্ষা বাদ দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নে শিক্ষকরাই গুরুত্বপূর্ণ। তারা প্রতিদিন পাঠদানের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কাজ দিয়ে শ্রেণিকক্ষে শিশুদের মূল্যায়ন করবেন। এতে পাঠের বিষয়বস্তু শিশু বুঝেছে কি না সেটি নিরূপন করা যাবে।” চমৎকার কথা বলেছেন জনাব রিয়াজুল হাসান।
ধারাবাহিক মূল্যায়ন নিয়ে আমি কয়েকটি লেখায় আমি এমন প্রস্তাবই করেছিলাম যে, শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীর সার্বিক কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন এবং তার কোন দিকগুলো পরিবর্তন হচ্ছে সেগুলো ডায়েরিতে লিখে রাখবেন। এটি একজন শিক্ষকের জন্য বিরাট গবেষণা। এটি তাকে শিশুশিক্ষা, শিশুবিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার করতে শেখাবে। তাকে চরম আনন্দও দেবে। তখন শিক্ষকতাকে আর বিরক্তিকর মনে হবে না। তিনি প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের আচরণ ও পরিবর্তন দেখার জন্য ক্লাসরুমে ছুটে আসবেন। এটিই শিক্ষকতা।
সপ্তাহ শেষে শিক্ষার্থীর ‘শিখণযোগ্যতা’ মূল্যায়ন করে শিক্ষক তার ডায়েরিতে লিখে রাখবেন। প্রতি তিনমাস পর শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে একটি গ্রেড বা নম্বর দিতে পারেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোন শিশু কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, কীভাবে এবং কতটা শ্রেণিকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে, কতটা দুষ্টুমি করছে সেগুলো অভিভাবক সভায়, শিক্ষক সভায় নিজের মতামতসহ অর্থাৎ একটি শিক্ষার্থীর আচরণ কোনদিকে যাচ্ছে, সেটি কিসের ইঙ্গিত বহন করছে ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবেন। এটি শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়েই হবে না, এতে শিক্ষকদের নিজেদের ডেডিকেশন থাকতে হবে, গভীর মনোযোগ থাকতে হবে এবং মোটিভেটেড হতে হবে।
এভাবে বছরে তিনটি মূল্যায়নের সমন্বয় করে শিশু পরবর্তী শ্রেণিতে পদোন্নতি পাবে। আগামী বছর নতুন বইয়ের সঙ্গে শিক্ষকদের জন্য একটি অ্যাপ তৈরির কাজ চলছে। তাতে শিক্ষার্থী ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্যাটাগরি ও ধাপ নির্ধারণ করে দেয়া হবে। শিক্ষকরা তা অনুসরণ করে শিশুদের মূল্যায়ন করবেন।
এছাড়া শিক্ষকদের ম্যানুয়ালও দেয়া হবে। শিশুদের জন্য প্রচলিত মূল্যায়নের চেয়ে ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্টই অধিকতর উপযোগী যেটি বুঝতে আমাদের অনেক সময়ে লেগে গেছে। তারপরেও অন্তত শুরু হতে যাচ্ছে,এটি ভেবেই স্বস্তি অনুভব করছি।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক । ২২ মার্চ,২০২০ ।