একাত্তরের জুন মাস। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে বীর বাঙালি। বীরের বেশে চালিয়ে যাচ্ছে লড়াই। এমন একটা সময়ে কোনোভাবেই নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারছিলাম না। যুদ্ধে যাব, সংগীতকে অস্ত্র বানিয়ে নেমে যাব লড়াইয়ের ময়দানে–এ ভাবনা থেকেই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পৌঁছে যাই সীমান্তের ওপারে।
অচেনা কলকাতার এদিক সেদিক খুঁজে ফিরে,একে ওকে জিজ্ঞেস করে বের করে ফেলি কড়া পাহারার কারণে বালিগঞ্জের ৫৭/৮ এর দোতলা বাড়িটি; যেখানে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা হয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। কড়া পাহারার কারণে সেখানে চাইলেই কেউ ঢুকতে পারত না। কিন্তু আমি ছিলাম নাছোড়বান্দা,কাউকে চিনি বা না চিনি, সেখানে আমাকে ঢুকতেই হবে, এটিই ছিল পণ। অবশেষে জুন মাসের ১৩ তারিখ সুযোগ হয়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পা রাখার। সেখানে গিয়েই পেয়ে যাই পরিচিত অনেকের দেখা।
মনে আছে,আমাকে দেখেই আবদুল জব্বার,কামাল লোহানী,আপেল মাহমুদসহ কয়েকজন একই সঙ্গে বলে উঠেছিলেন, ‘এ যে আইসা গেছে, আইসা গেছে। আর চিন্তা নাই।’ তাদের এ কথা শুনে মনে হয়েছিল, আমি যে আসছি,তা যেন আগে থেকেই জানা ছিল তাদের। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাওয়ার পর কামাল লোহানী জানিয়েছিলেন, সেখানে খাওয়া-দাওয়া সব ফ্রি। মাসে হাতখরচ বাবদ ৫০ টাকা দেয়া হবে। তাঁর এ প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।
যা-ই হোক,ভ্রমণের ক্লান্তিতে সেদিন দুপুরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যা হতে না হতেই কানে এলো বন্ধু আপেল মাহমুদের ডাক। ‘মামু ও মামু ওঠ’– আপেলের এই ডাক শুনে ঘোরে আঁতকে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম,পাকিস্তানি বাহিনী বোধ হয় আক্রমণ করেছে। কিন্তু না। পরে জানলাম, ও একটা গান লিখে তাতে সুর বসিয়েছে, এখন সেই গানে কণ্ঠ দিতে হবে। এরপর কিছুক্ষণ রিহার্সাল দেওয়ার পর রেকর্ড করা হয় সেই গান, তীরহারা এ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে…।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পা রাখার প্রথম দিনেই গান রেকর্ড করা অভিজ্ঞতা হবে এবং সেই গানটি কালজয়ী হয়ে উঠবে,তা ছিল সত্যি অকল্পনীয়।
চাঁদপুর টাইমস
১২ ডিসেম্বর ২০২৪
এজি