তাৎপর্যবহ হিজরি বর্ষ

১৪৪৪ হিজরি সন বিদায়ের পর শুরু হয়েছে নতুন হিজরি বর্ষ-১৪৪৫। হিজরি বর্ষের সূচনা ও সমাপ্তি দুটোই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জিলহজ মাসের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে হিজরি বর্ষ সমাপ্ত হয় আর সূচনা হয় মহররম মাসের মাধ্যমে। জিলহজ মাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইবাদত হজ ও কোরবানি আদায় করা হয়। আর মহররম হচ্ছে কুরআন মাজিদের ভাষায় ‘আরবাআতুন হুরুম’ অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম। এ হিসেবে হিজরি বর্ষ সূচনা ও সমাপ্তি উভয় দিক থেকেই অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ, মহিমান্বিত ও তাৎপর্যবহ।

বহু প্রাচীনকাল থেকে সন গণনা প্রচলিত। আরবদের মধ্যে গোত্রগত বিভাজনের কারণে নানা ধরনের বর্ষ গণনা করা হতো। তবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো বর্ষ ছিল না। হিজরতের ১৭ বছর পর দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তখন অনেক নতুন ভূখণ্ড ইসলামি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় কাগজপত্র ইত্যাদিতে সাল-তারিখ উল্লেখ না থাকায় অসুবিধা হতো। তখন কুফার গভর্নর ছিলেন হজরত আবু মুসা আল আশয়ারি (রা.)। তিনি প্রশাসনিক কাজের অসুবিধার কথা জানিয়ে সন ও তারিখ নির্ধারণের আবেদন করেন। ওই আবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে এবং প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে হজরত ওমর (রা.) একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করেন।

যেহেতু নবী কারিম (সা.)-এর হিজরতেই ইসলামের পূর্ণতা লাভ, কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র গঠন এবং মানব ইতিহাসে নবদিগন্তের সূচনা করে, তাই সে সভাতেই নবী কারিম (সা.)-এর হিজরতের বছরকে সন গণনার বছর হিসেবে নির্ধারণের জন্য হজরত আলী (রা.) পরামর্শ দেন। মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ হিজরি সালের শুরু করা এবং জিলহজ মাসকে সর্বশেষ মাস হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দেন হজরত উসমান (রা.)। সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। আর তখন থেকেই ইসলামি বর্ষ বা হিজরি সন গণনার শুরু।

হিজরত শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বরং পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করেছেন শুধু দ্বীনের খাতিরে, আল্লাহর আদেশে। আর নবী কারিম (সা.)-এর সাহচর্য অবলম্বন করে দ্বীনের শিক্ষা ও আদর্শকে ধারণ করার জন্য তার প্রচার-প্রসার,বিজয় ও প্রতিষ্ঠার জন্য হিজরত করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। এ হিজরতকারী সাহাবায়ে কেরামের পরিচিতি হচ্ছে ‘মুহাজির’। আর যারা তাদের গ্রহণ করেছেন পূর্ণ একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের পরিচিতি ‘আনসার’। পবিত্র কুরআনে সুরা হাশরের ৮-৯ আয়াতে এক প্রসঙ্গে এ সৌভাগ্যবানদের গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত হয়েছে।

ইরশাদ হয়েছে, ‘এ সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি থেকে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাহায্য করে। তারাই তো সত্যাশ্রয়ী। আর যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এ নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ঈমানকে ধারণ করেছে। তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেয়া হয়েছে তার জন্য অন্তরে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না। আর তাদের নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদের অন্তর কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম।’

হিজরি বর্ষের সূচনা মাস মহররম। এ মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। পৃথিবীর বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এদিন সংঘটিত হয়েছে। হজরত মুসা (আ.) ও বনী ইসরাঈলকে আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের কবল থেকে অলৌকিকভাবে মুক্ত করেছিলেন এবং ফেরাউনকে লোহিত সাগরে নিমজ্জিত করেছিলেন। এদিন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র ও সাহাবি হজরত হোসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন।

মানুষ প্রয়োজনে বিভিন্ন কাজের সুবিধার্থে দিন-তারিখ ঠিক রাখতে কোনো না কোনো বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত বাংলা,ইংরেজি ও হিজরি তিনটি ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে হিজরি সনের সম্পর্ক চন্দ্রের সঙ্গে। বিশ্বের প্রায় দেড়শ কোটি মুসলমান এ সন ব্যবহার করেন। মুসলমানদের কাছে হিজরি সন গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ চাঁদের হিসাবে মুসলমানদের অনেক ইবাদত-বন্দেগি, আমল-অনুশাসন পালিত হয়, এ কারণে হিজরি সনের মাহাত্ম্য মুসলমানদের অন্তরজুড়ে বিশেষ মর্যাদায় সমাসীন।

২১ জুলাই ২০২৩
এজি

Share