দুধের জানা-অজানা তথ্য

দুধ সুপ্রাচীনকাল থেকেই একটি সুস্বাদু ও উপাদেয় সুষম খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। দুধে প্রায় সব পুষ্টি উপাদান উপস্থিত থাকে বিধায়,চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা প্রায়ই দুধপানের পরামর্শ দেন।

সাম্প্রতিককালের কয়েকটি বই ও গবেষণাপত্রের বরাত দিয়ে কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দাবি করছে,দুধের পুষ্টিগুণের পাশাপাশি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সেসব গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এ২ (A2) দুধ শরীরের জন্য ভালো হলেও এ১ (A1) দুধ-এর কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

২০০০ সালে এ২ করপোরেশন (নিউজিল্যান্ডে অবস্থিত) নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ২ দুধ (এ২ বিটা-ক্যাসেইন প্রোটিন সমৃদ্ধ এবং এ১ বিটা-ক্যাসেইন প্রোটিনমুক্ত দুধ) বাজারজাত শুরু করে।

তৎকালীন বাজারে প্রচলিত গরুর দুধকে এ১ দুধ আখ্যা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দাবি করে,প্রচলিত গরুর দুধে এমন এক ধরনের প্রোটিন (এ১ বিটা-ক্যাসেইন প্রোটিন) থাকে যেটি হৃদরোগ, টাইপ-১ ডায়াবেটিস এবং সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক রোগসহ নানাবিধ রোগ সৃষ্টি করে।

এ প্রতিষ্ঠানটি ২০০২ সালে আদালতে এ১ দুধ-এর ক্ষতিকর দিক উল্লেখপূর্বক, নিউজিল্যান্ড দুধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করে। যদিও দাবিটি পরবর্তী সময়ে সত্য প্রমাণিত হয়নি। এ১ দুধ এবং এ২ দুধ-এর ধারণাটা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে ২০০৭ সালে দুধের ডেভিল (Devil in the milk)

নামের গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর। লেখক কে বি উডফোর্ড (K B Woodford) বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে এ১ দুধ ও এ২ দুধ-এর নানাদিক তুলে ধরেন। মূলত এরপর থেকেই এ২ দুধ-এর ধারণা সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হতে থাকে।

বিষয়টি সহজে বোঝার জন্য আসুন গরুর দুধের উপাদান বিষয়ে চোখ বোলানো যাক। গরুর দুধে ৮৭% পানি এবং ১৩ % কঠিন (সলিড) পদার্থ থাকে। গরুর জাতভেদে এটা কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। সলিড পদার্থের মধ্যে থাকে মিল্কফ্যাট,কার্বোহাইড্রেট,মিনারেলস এবং মিল্কপ্রোটিন। প্রোটিনের মধ্যে আবার ৮০% উপাদান হলো ক্যাসেইন প্রোটিন। আর এই ক্যাসেইনের মধ্যে আবার ৩০-৩৫% হলো বিটা-ক্যাসেইন,যেটা ১ লিটার দুধের মধ্যে এক থেকে দেড় চা-চামচ পরিমাণ হতে পারে। বিটা-ক্যাসেইন হচ্ছে ২০৭টি অ্যামাইনো অ্যাসিডের সমন্বয়ে সৃষ্ট একটি প্রোটিন যৌগ।

এ অ্যামাইনো এসিডগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে থেকে শিকলের মতো গঠন তৈরি করে। পুরোশিকলে অ্যামাইনো এসিডের অণুগুলো নির্দিষ্টক্রমে সজ্জিত থাকলেও শিকলের ৬৭তম অবস্থানে একটু ভিন্নতা দেখা যায়।

শিকলের ৬৭ নম্বর অবস্থানে হিস্টিডিন নামক অ্যামাইনো এসিড থাকলে সেই বিটা-ক্যাসেইনকে এ১ বিটা-ক্যাসেইন এবং ওই অবস্থানে হিস্টিডিনের পরিবর্তে প্রোলিন নামক অ্যামাইনো এসিড থাকলে তখন তাকে এ২ বিটা-ক্যাসেইন বলে। দুধে কোনও ধরনের বিটা-ক্যাসেইন প্রোটিন থাকবে, সেটা নির্ভর করে গাভীর জিনগত বৈশিষ্ট্যের ওপর।

কোনও জাতের গাভীর দুধে তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে উভয় এ১ এবং এ২ প্রকারের বিটা-ক্যাসেইন পাওয়া যায়। তবে, কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির দুধে এ১ বিটা-ক্যাসেইন এবং এ২ বিটা-ক্যাসেইনের মধ্যে যেকোনও একটি অবস্থান করে। ভালোভাবে বললে, যেসব প্রাণীর দুধে এ১ বিটা-ক্যাসেইন পাওয়া যায় সেসব দুধকে এ১ দুধ এবং যেসব প্রাণীর দুধে এ২ বিটা-ক্যাসেইনের আধিক্য থাকে সেসব দুধকে এ২ দুধ বলা হয়।

তবে এ২ দুধ বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের দাবি অনুযায়ী, তাদের বাজারজাতকৃত দুধে বিটা-ক্যাসেইন হিসেবে শুধু এ২ বিটা-ক্যাসেইন থাকে এবং কোনরূপ এ১ বিটা-ক্যাসেইন থাকে না। আসুন কেন এই বৈচিত্র্য সে বিষয়ে চোখ বোলানো যাক। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আজ থেকে হাজার বছর আগেও দুধের বিটা-ক্যাসেইন শিকলের গঠন, জাত নির্বিশেষে একই ছিল।

কালের পরিক্রমায়, কিছু জাতের গরুতে মিউটেশন (জিনের আংশিক পরিবর্তন) হয় এবং এর প্রভাবে কয়েকটি জাতের গরুর দুধের বিটা-ক্যাসেইন শিকলের ৬৭ নম্বর অ্যামাইনো এসিডে পরিবর্তন আসে। এভাবেই বিটা-ক্যাসেইন-এর এ১ বিটা-ক্যাসেইন এবং এ২ বিটা-ক্যাসেইন নামে দুটি প্রকরণ সৃষ্টি হয়।

জিনের এ পরিবর্তন বংশ পরম্পরায় বজায় থাকে এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আসুন এ১ এবং এ২ দুধ-এর উৎস বিষয়ে চোখ বোলানো যাক। গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলের স্থানীয় গরুর জাতগুলো এবং কিছু ইউরোপীয় গরুর জাত (যেমন জার্সি, গুয়ের্নসি) এ২ দুধ উৎপাদন করে। অন্যদিকে, ইউরোপীয় অঞ্চলের গরুগুলো (ফ্রিজিয়ান, আয়েরশার ইত্যাদি) এ১ দুধ উৎপন্ন করে। আরেকটি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে,মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও উটের মতো প্রাণীরাও এ২ দুধ উৎপন্ন করে।

দুধ যখন আমাদের পরিপাকতন্ত্রে পৌঁছায়,তখন পরিপাকতন্ত্রের এনজাইমের ক্রিয়ায় দুধের প্রোটিন অণুগুলো ভেঙে গিয়ে ছোট ছোট পলিপেপটাইড অণুতে পরিণত হয়। কয়েক ধাপের বিপাকীয় ক্রিয়ার পর,পলিপেপটাইড অণুঅন্ত্রে শোষিত হয়। দুধ যখন আমাদের অন্ত্রে পৌঁছায়, তখন দুধে থাকা এ১ বিটা-ক্যাসেইন অণুঅন্ত্রের এনজাইমের প্রভাবে ভেঙে বিটা-ক্যাসোমরফিন-৭ (BCM-7) নামক একটি পেপটাইড তৈরি করে।

তবে, এ২ বিটা-ক্যাসেইনের গঠনে ভিন্নতা থাকায় এ২ দুধ পান করলে BCM-7 তৈরি হয় না। মূলত এই BCM-7 পেপটাইডটি, অন্ত্রের প্রদাহসহ দুধপানের কারণে মানবদেহে সৃষ্ট অন্যান্য সমস্যার জন্য দায়ী হয়ে থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন।

এখন বাস্তবতা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিষয়ে চোখ বোলানো যাক। আগেই বলছি বি. উডফোর্ড নামে একজন গবেষক ২০০৭ সালের জুন মাসে প্রকাশিত দুধের ডেভিল গ্রন্থে, বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে,দুধ পানের সঙ্গে টাইপ-১ ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো কিছু রোগের সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন।

তিনি এ১ দুধ-এর বদলে এ২ দুধ পান করার পরামর্শ দেন। কিন্তু, ২০০৬ সালের মে মাসে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক সাময়িকী ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন-এর একটি নিবন্ধে অধ্যাপক এ এস ট্রাসওয়েল উল্লেখ করেছেন, গরুর দুধের এ১ বিটা-ক্যাসেইনের কারণে মানুষের দেহে টাইপ-১ ডায়াবেটিস কিংবা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে, এমন ধরনের কোনও যৌক্তিক প্রমাণ তিনি খুঁজে পাননি।

পরবর্তী সময়ে, ইউরোপীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (EFSA) বিভিন্ন গবেষণা কর্ম পর্যালোচনা করে অধ্যাপক ট্রাসওয়েলের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে। EFSA কর্তৃপক্ষ ২০০৯ সালে একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে বিষয়টি আরও বিশদভাবে উল্লেখ করে বলেছে,এ১ দুধ পানের সঙ্গে মানবদেহে রোগসৃষ্টির কোনও সম্পর্ক নেই। সে বছরই,অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড খাদ্যমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান (FSANZ) ও একই মত প্রকাশ করে, ক্রেতা সাধারণকে এ১ দুধ এবং এ২ দুধ-এর মধ্যে কোনও ভেদাভেদ না করে, নির্ভয়ে দুধপান করতে সুপারিশ করেছে।

উপরোক্ত বিষয় পর্যালোচনায় বলা যায়, অল্প সংখ্যক মানুষের ওপর চালানো একটি গবেষণায় কিছু সংবেদনশীল মানবদেহে এ১ বিটা-ক্যাসেইনের কারণে অন্ত্রের প্রদাহ ও বদহজমসহ তৎসামান্য জটিলতা দেখা গেলেও এটা নিশ্চিত নয় যে শুধু এ১ বিটা-ক্যাসেইন এর জন্য দায়ী।

এর জন্য আরও বিশদ পরিসরে গবেষণার প্রয়োজন। খোদ গবেষকরাই এখনও এ১ বিটা-ক্যাসেইনকে একটি ক্ষতিকর উপাদান হিসেবে আখ্যা দিতে নারাজ। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় যে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশের খাদ্যমান নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এ১ বিটা-ক্যাসেইনের সঙ্গে রোগ সৃষ্টির সম্পর্ক খুঁজে পায়নি, বরং তারা নির্ভয়ে দুধপানের পরামর্শ দিয়েছে।

তাই পরিশেষে বলতে চাই, এ১ দুধ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার সময় এখনও আসেনি। বরং আমাদের উচিত এ১ দুধ ও এ২ দুধ বিতর্কে কান না দিয়ে, নিয়মিত দুধপান করে দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।

লেখক: ড.একেএমএম হুমায়ুন কবির, অধ্যাপক (দুগ্ধ বিজ্ঞান),চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু), চট্টগ্রাম। akmhumayun@cvasu.ac.bd
৫ মার্চ ২০২২ ।

Share