তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষক সংকটে চাঁদপুরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদান যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি শিক্ষার্থীদের ফলাফল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় জেলায় প্রায় ৪শ’ কম্পিউটার ল্যাব নিষ্ক্রিয় রয়েছে। এছাড়া অধিকাংশ কম্পিউটার নষ্ট হয়ে সরকারের লাখ লাখ টাকা অপচয় হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বর্তমান মহাজোট সরকার একযোগে ডিজিটাল (তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর) বাংলাদেশ গড়তে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে নবম-দশম শ্রেণিতে কম্পিউটার শিক্ষা চালু করে। শিক্ষার্থীদের অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির ধারণা প্রদান করতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মন্ত্রণালয় শিক্ষার্থীদের চাহিদার বিপরীতে শিক্ষাঙ্গনে চালু করে কম্পিউটার ল্যাব। যা পরবর্তীতে আইসিটি ল্যাবে উন্নতি করে সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া চাঁদপুরে আইসিটি ল্যংগুয়েজ ল্যাব রয়েছে বলেও জানিয়েছে জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র।
এদিকে চাঁদপুুরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে ৪ শতাধিক আইসিটি (ইনফরমেশন এন্ড কমিউনেকেশন টেকনোলজি বা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। তবে জেলা শিক্ষা অফিসের মতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। অধিকাংশদের’ই প্রয়োজনীয় উপকরণসহ মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করা হয়েছে।
জেলা শিক্ষা অফিসের মতে, আইসিটি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে স্বল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানে। তবে অভিজ্ঞ শিক্ষক টেকনিশিয়ান (প্রশিক্ষক) না থাকায় আইসিটি ল্যবাগুলো (১৭টি ল্যাপটপ নিয়ে) প্রায়’ই থাকে বন্ধ। এছাড়া ওইসব প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরও আইসিটি’র উপর সম্যক ধারণা নেই। ফলে প্রতিষ্ঠান প্রধানরাও ল্যাবের প্রতি আগ্রহ দেখান না। সে কারণে ল্যাবগুলোর প্রকৃত সুফল পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা।
জেলা শিক্ষা অফিস জানায়, কেবল ২০১৪ সালে জেলার ৩শ’ ৬৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপনসহ মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও ইন্টারনেট সংযেগের জন্যে মডেম সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে কলেজ ৩৪টি, স্কুল ২শ’ ২৫টি এবং মাদ্রাসা ১শ’ ৯টি। উপজেলাভিত্তিক- চাঁদপুর সদর উপজেলায় ৬৪টি, হাজীগঞ্জে ৫৩টি, কচুয়ায় ৬২টি, শাহরাস্তিতে ৫২টি, মতলব দক্ষিণে ৩০টি, মতলব উত্তরে ৩৩টি, ফরিদগঞ্জে ৬২টি এবং হাইমচর উপজেলার ১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
অধিকাংশ স্কুল-কলেজে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার ল্যাব স্থাপনে উপকরণ বরাদ্দ দিলেও দেয়া হয়নি অভিজ্ঞ শিক্ষক কিংবা টেকনিশিয়ান। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর সাধারণ শিক্ষকদের বিভিন্ন সময়ে আইসিটির উপর স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সংশ্লিষ্টরা। তারা ল্যাব পরিচালনার দায়িত্ব নিলেও স্বল্প প্রশিক্ষণের কারণে নিজেরাই বিষয়গুলো বুঝতে পারেন না। ফলে তারা ল্যাব পরিচালনায় আগ্রহী থাকে না। আর এজন্যই অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার ল্যাবগুলোতে দেখা যায় ধূলোবালুর স্তূপ।
এসব বিষয়ে বেশ ক’জন শিক্ষকের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, অপরিকল্পিত উপায়ে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিটি ও কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছে। বিশেষ করে মফস্বলের বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজগুলোতে নিয়মিত বিদ্যুৎ থাকে না। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয়নি কম্পিউটারে অভিজ্ঞ শিক্ষক। সে কারণেই ল্যাবের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে বলে তারা জানান।
এছাড়া অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর প্রদান করা হয়েছে যাতে শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের জন্য চিত্রভিত্তিক ডিজিটাল কন্টেইন বা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করা সম্ভব হয়। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চিত্রভিত্তিক স্বচ্ছ ও বাস্তব নির্ভর ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানগুলো মাসে একবারও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করেন না বলে জানায় শিক্ষার্থীরা। এজন্য অবশ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ না থাকাসহ শিক্ষক স্বল্পতাকে দায়ী করছে।
বর্তমানে জেলার ৮৫ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার (তথ্য-প্রযুক্তির) শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নিয়মতান্ত্রিকভাবে কম্পিউটার বিষয় চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে অনেকেই এখন বাধ্য হয়ে সৃষ্ট পদ তৈরি করে আইসিটি শিক্ষক নিয়েগের জন্য অবেদন চেয়েও শিক্ষক পাচ্ছে না বলে বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠান প্রধান জানান। ফলে তাদের আইসিটি ল্যাবের সেবা শিক্ষার্থীদের দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কেবল বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রকল্পে প্রশিক্ষণ প্রদান করায় তাদের দিয়ে ল্যাব সচল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অপরদিকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিটি ল্যাব থাকলেও তা’ তাদের কাজে আসছে না। কারণ হিসেবে তারা দাবি করেন, শিক্ষকরা তাদের জন্য যেমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে না, তেমনি কম্পিউটার নষ্টের ভয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের ল্যাব ব্যবহারও করতে দেন না। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্র্যাকটিকাল ব্যবহারের সুযোগও পাচ্ছে না।
অভিভাবকদের দাবি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিটি ল্যাব থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে তাদের সন্তানদের জন্য অতিরিক্ত শিক্ষক রেখে বাসায় বা কোচিং সেন্টারে আইসিটি বা কম্পিউটার শিক্ষা পড়াতে হয়। এজন্য প্রত্যেক মাসে অতিরিক্তি অর্থ ব্যয় করতে হয়। অথচ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার সফিউদ্দিন আহম্মেদ জানান, চাঁদপুরের সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও আইসিটি ল্যাব সচল আছে। কোথাও তেমন প্রতিবন্ধকতা নেই। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন স্কুলে ৪ শতাধিক মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর রয়েছে। ল্যাংগুয়েজ ক্লাব রয়েছে ১৭টি এবং কম্পিউটার ল্যাব রয়েছে ৬০টি। এছাড়া চলিত বছরে আরো ৩৫টি আইসিটি ল্যাব স্থাপন করা হবে বলে তিনি জানান।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আরো জানান, জেলার মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজের প্রায় ১২শ’ শিক্ষককে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। গড়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২-৩ জন শিক্ষক প্রশিক্ষণের আওতায় এসেছে। বর্র্তমানে জেলার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই তথ্য-প্রযুক্তির আওতায় এসেছে বলে তিনি দাবি করেন। তবে দ্রুত শতভাগে উন্নীত করতে কাজ চলছে বলে তিনি জানান। এছাড়া যেখানে বিদ্যুৎ নেই সেসব প্রতিষ্ঠানে সোলার স্থাপন করা হবে বলেও তিনি জানান।
এ কর্মকর্তার মতে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই কম্পিউটারসহ অনান্য যন্ত্রাংশ সচল রয়েছে। তবে কারিগরি যন্ত্রপাতি হওয়ায় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে দু’একটি কম্পিউটার বা অন্য কোনো যন্ত্র নষ্ট হয়ে থাকতে পারে। তবে ল্যাব ব্যবহার করা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান চাঁদপুরে নেই বলে তিনি দাবি করেন।
রেজাউল করিম
||আপডেট: ০৮:৩৭ পিএম, ০৮ নভেম্বর ২০১৫, রোববার
এমআরআর