‘নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌছাইতাম, বিদেশ গিয়া বন্ধু তুমি আমায় ভুইলোনা, চিঠি দিও পত্র দিও জানাইও ঠিকানারে,জানাইও ঠিকানা,কিংবা চিঠি দিও প্রতিদিন চিঠি দিও,নইলে থাকতে পারবোনাৃ.।’
এক সময় প্রায়ই রেডিও স্যাটালাইটে শোনা যেতো এ রকম কতনা কালজয়ী গান। দিন বদলের পালায় এরকম মনোমুগ্ধকর কালজয়ী গানগুলো আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে বহু আগেই। সেই সাথে কালের বির্বতনে হারিয়ে যাচ্ছে ডাকযোগে চিঠি পত্রের ব্যাবহার।
এক সময় মানুষের সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিলো ফ্যাক্স ও ডাক যোগাযোগ । আজ থেকে প্রায় দশ বারো বছর আগে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন অথবা অতি আপনজন দুরদুরান্ত থেকে ফ্যাক্স কিংবা ডাকযোগে চিঠি পত্রের মাধ্যমে আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ এবং খোঁজ খবর নিতো।
আর্থিক লেনদেনও করা হতো ডাকযোগের মাধ্যমে। বাবা, মা ভাই, বোন, স্ত্রী পুত্র কিংবা প্রিয় মানুষটি প্রিয়তমার চিঠির অপেক্ষায় থাকতো। প্রিয় মানূষটি অথবা অতি আপন জনের সেই চিঠি হাতে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হতো অপেক্ষকৃত ব্যক্তিটি।
তখনকার দিনে সেই আনন্দ অনুভূতিই ছিলো অন্যরকম। কিন্তু কালের বির্বতনে এখন আর শহর কিংবা গ্রামগঞ্জে ডাকযোগে চিঠিপত্রের তেমন ব্যাবহার নেই।
বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে। অনেক উন্নত পরিসরে চলছে মানুষের সামাজিক যোগাযোগ ব্যাবস্থা। এখন মানুষ ডাকযোগে যোগযোগের মাধ্যম পরিহার করে মোবাইল , ইন্টারনেট, ফেসবুকিং, ই-মেইল, কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনসহ প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করে থাকেন।
আর এসবের ব্যাবহারও চলছে জোরালো গতিতে। তাই মানুষজন এখন ভুলে গেছেন সেই প্রাচীনকালের ডাকযোগে চিঠি পত্রের কথা।
এজন্য এখন গ্রাম গঞ্জের অনেক স্থানের ইউনিয়নের বাজারে গেলেই দেখাযায় সেখানকার পোস্ট অফিস থাকলেও নেই কোন কার্যক্রম। সেই পোস্ট অফিসে চিঠিপত্র জমা রাখার বক্স থাকলেও বক্সে নেই কোনো চিঠি।
বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যায়, চাঁদপুর শহরের পালবাজার সংলগ্ন পোস্ট অফিসে আগের তুলনায় চিঠি প্রদানকারী কোন ব্যাক্তির তেমন কোন আনাগোনা নেই।
শুধুমাত্র বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, কিংবা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চিঠিপত্র পোস্ট অফিসের মাধ্যমে আদান প্রদান হয়ে থাকে। একই পরিস্থিতি তার পাশে থাকা জেলা টেলিগ্রাম অফিসের।
সরজমিনে দেখা যায় জেলা টেলিগ্রাম অফিস থাকলেও সেখানে নেই তেমন কোন কার্যক্রম। অফিসটিও পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
কথা হয় জেলা টেলিগ্রাম অফিসের টেলিগ্রাম মাস্টার মোঃ মামুন মিয়ার সাথে তিনি জানান, টেলিগ্রাম অফিসে কার্যক্রম আছে ঠিকই। তবে আগের তুলনায় তা এখন অনেক কম। একসময় যে পরিমানে টেলিগ্রাম আসতো সে তুলনায় এখন তা অনেক কমে গেছে। এখনো কিছু কিছু টেলিগ্রাম হয়। আর সেগুলো হলো বিভিন্ন অফিসিয়াল, ব্যাংক, আবহাওয়া বার্তা ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেলিগ্রাম।
তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে অফিসের সংস্কার না হওয়ায় টেলিগ্রাম অফিসটি এভাবে পড়ে আছে।
এছাড়াও জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের পোষ্ট অফিসে গিয়ে এমনই দৃশ্য চোখে পড়ে।দেখাযায় ওইসব পোস্ট অফিসের সামনে চিঠিপত্রের বক্স মরিচা ধরে নাজুক অবস্থায় পড়ে আছে। কিন্তু তাতে নেই কোন চিঠি। এভাবেই কালের বির্বতনে ডাকযোগের মাধ্যমে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে চিঠি পত্রের ব্যাবহার।
দেশে টেলিগ্রামের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হয়েছে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। এই টেলিগ্রামের মাধ্যমেই বিশ্ব দরবারে পৌঁছেছিল পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার খবর। আর্চার কেবাড তখন ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন কূটনীতিক। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কনসাল জেনারেল নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে তৎকালীন চলমান নৃশংসতা বন্ধে কঠোর ভাষায় একটি টেলিগ্রাম বার্তা পাঠানোর জন্য বিখ্যাত। তার সেই বিখ্যাত টেলিগ্রাম বার্তা ‘বাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিত।
বর্তমানে নামমাত্র চললেও বহু আবেগ মিশে আছে এই টেলিগ্রামের সঙ্গে। ঢাকা সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস সূত্রে জানা যায়, এক সময় আড়াই হাজারের মতো জনবল ছিল এই টেলিগ্রাফে। এখন আছে শ’তিনেকের মতো। কাজ করেন অন্য দফতরে। বাংলাদেশে প্রায় ৮শ’ টেলিগ্রাফ অফিস ছিল। আর এখন ৬৪ জেলার আছে ৪০টির মতো অফিস। তাও চলছে ধিক ধিক করে। কোথাও ঘরটি পরিত্যক্ত হয়েছে। আর কোন ঘরে জমেছে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। তবে ওই ঘরগুলোতে এখন আর নেই টেলিগ্রাফের টরে টক্কা যন্ত্র। কোথাও আছে একটি ফ্যাক্স মেশিন, আবার কোথাও আছে একটি ল্যান্ড টেলিফোন।
প্রতিবেদক- কবির হোসেন মিজি
: আপডেট, বাংলাদেশ ১১ : ৫৯ পিএম, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭ বুধবার
ডিএইচ